কিছু বেড়ানো কিছু গল্প

মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। কোথায় যাওয়ার কথা ছিল আর কোথায় গিয়ে উঠলাম। মানে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম এক জায়গায়, গিয়ে পৌঁছালাম আর এক জায়গায়। যেখানে গিয়ে পৌঁছালাম সেখানে আমি আগেও দু-বার গিয়েছি। কিন্তু আমি গেলে কি হবে আমার আত্মজা কোনদিন যায়নি তাই তার সাধ পূরণ করতে যাত্রা করলাম সেই চেনা পথে। প্রায় সব বাঙালীর মোটীমুটি পরিচিত জায়গা। মানে আমি দার্জিলিং এর কথা বলছিলাম আর কি।
যাই হোক দূর্গাপুর থেকে বর্ধমান গিয়ে পৌঁছালাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। বর্ধমান থেকে ট্রেন রাত সাড়ে ন'টায় তাই রেলের প্রতিক্ষালয়ে দু-ঘন্টার জন্য ঘাঁটি গাড়লাম।
এই প্রতীক্ষালয় একটা বেশ দেখার জিনিস। কত রকম মানুষজন, তাদের প্রত্যেকের নানা রকম পোশাক, নানা রকমের ভাবভঙ্গী আমার কিন্তু বেশ লাগে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগে এই প্রতীক্ষালয়ে বসে ছবি আঁকাতে মগ্ন কিছু ছেলেমেয়েকে। মনে হয় তারা আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী। তারা নিজের মনে প্রতীক্ষালয়ে বসে বা শুয়ে থাকা যাত্রীদের প্রতিছবি নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলছে সাদা কাগজের উপর। তাদের দক্ষ হাতের পেনসিল চালনা দেখতে দেখতে সময় যে কখন পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। তাদের আঁকা দেখতে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে সেই মূহুর্তটাকে ক্যামের বন্দী করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাত্‍ ট্রেনের আগমন ঘোষনায় চমক ভেঙে দৌড় লাগালাম ব্যাগপত্র নিয়ে। যাইহোক, ট্রেনে চেপে রাত কাটিয়ে পরদিন পৌঁছালাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। ভাগ্যিস আমার কন্যা জলপাইগুড়ি নামের উত্‍স সম্বন্ধে জানতে চায় নি, কারণ যে কোন জায়গায় গেলে সেই জায়গার নামের উত্‍স নিয়ে সে একটু বেশী উত্‍সুক হয়ে পড়ে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে চলে এলাম শিলিগুড়ি। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর অবশেষে দার্জিলিং এর বাস পেলাম। আসলে প্রাইভেট গাড়ি বা শেয়ারের গাড়িতে যাওয়া আমার না পসন্দ। তার চেয়ে পাহাড়ী রাস্তায় এই বাস আমার কাছে অনেক বেশী আরামদায়ক। আর আমার সহধর্মিনী ও কন্যারও এই বাস বেশ পছন্দের। বাসে চেপেই মেয়ের প্রশ্ন আচ্ছা বাবা, এই জায়গাটার নাম শিলিগুড়ি কেন ? 
নাও এবার বোঝ ঠেলা !
যাইহোক তখন কার মতো তাকে বললাম যে তোকে দার্জিলিং গিয়ে বলব এই গল্পটা বলব।
বাসে যেতে যেতে ভাবছিলাম এই শিলিগুড়ি নামের উত্‍স নিয়ে বহু বছর আগে একটা লেখা পড়েছিলাম। আসলে কোন নতুন জায়গায় গেলে তার সম্বন্ধে মোটামুটি জেনে যাওয়া আমার একটা পুরানো অভ্যেস।
কার্সিয়াং টুং সোনাদা ঘুম পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং।
পুরানো কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এবার আগের থেকে কোন হোটেল বুক করিনি। আর যেহেতু এই সময় পর্যটকদের আসা-যাওয়া একটু কম তাই হোটেল পেতে খুব একটা সমস্যা হলো না। ম্যালের থেকে মিনিট দুয়েকের হাঁটা পথের দূরত্বে হোটেন পেয়ে গেলাম।
পরের দিন মানে ১০ই ডিসেম্বর ছিল ১২ ঘন্টার দার্জিলিং বন্ধ। কোথাও যাওয়ার নেই, শুধু ম্যালের আসেপাশে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটানো।

কুয়াশাছন্ন দার্জিলিং ম্যাল
তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সহধর্মিনী ও আমি হাতে চায়ের গ্লাস নিয়ে ম্যালের বেঞ্চে এসে বসলাম। বন্ধ ততক্ষন শেষ। কয়েকজন পর্যটক ইতিউতি ঘুরছে, কয়েক জন আমাদের পাশাপাশি বেঞ্চে বসে আছে।আমার মেয়ে সামনেই ঘুরে বেড়াছিল। হঠাত্‍ কি মনে হতে আমার পাশে এসে বসলো। আমি বললাম - কিরে কিহলো বসে পড়লি
যে ? ও বলল - বাবা তুমি যে বললে সেই শিলিগুড়ি নামের মানে বলবে?
আমি বললাম সে কিরে এখনই বলতে হবে ! ও বলল হ্যাঁ এখনই বলো। অগত্যা আমি বললাম তাহলে শোন আমি কিন্তু অনেকদিন আগে পড়েছি হয়তো কিছু ভুলও হতে পারে তবে গল্পটা মোটামুটি এইরকম -
শিলিগুড়ি কিন্তু জায়গাটার আসল নাম নয়। ইংরেজদের উচ্চারণের দোষে আজ শিলিগুড়ি হয়ে গেছে। এই জায়গাটার আসল নাম হল শ্যালিগ্রি। এই শব্দটা লেপচাদের ভাষা। নেপালীরা এটাকে শিলগুড়ি বানালো আর ইংরেজরা বানালো শিলিগুড়ি। লেপচাদের ভাষায় এই শ্যালিগ্রি শব্দটার মানে হল ' ধনুকে ছিলা পরাও'। সময়টা ছিল ইংরাজীর 1825 কি 1826 সাল ( এই সাল তারিখ আমার কিছুতে মনে থাকে না। তাই এক্ষেত্রেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ) । তখন সিকিমের রাজা ছিলেন শুকপুট নামগেল। সেই সময় ইংরেজ সেনাবাহিনীর সাথে লেপচাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে প্রচুর ইংরেজ সৈন্য মারা যায়। কিন্তু লেপচাদের মাত্র একজন সৈন্য মারা যায়। তার নাম ছিল ডুনো-রাপগে। ডুনো একটা শুকনো গাছের খোলে লুকিয়ে বিষ মাখানো তীর ছুঁড়ে ইংরেজ সৈন্যদের মেরে গেছে। ইংরেজরা প্রথমে তার হদিস করতে পারেনি। কিন্তু পরে ইংরেজরা তার খোঁজ পেয়ে যায়। সেই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ডুনো মারা যায়। এই ডুনো লেপচাদের জাতীয় নায়কের মর্যাদা পায়।ইংরেজরা সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হয় যে একজন অশিক্ষিত সৈনিক কি করে এভাবে লড়াই করতে পারে! কারণ ডুনো ওই শুকনো গাছের খোলে টানা সাতদিন লুকিয়ে ছিল। কিন্তু টানা সাতদিন কিছু না খেয়ে কিভাবে সে এমন যুদ্ধ করতে পারে সেই প্রশ্ন ইংরেজদের ভাবিয়ে তুলেছিল। তাই ইংরেজরা ডুনোর মৃত্যুর পর ডুনোর পেট কেটে দেখেছিল। দেখাগিয়েছিল যে সে কোন উত্তেজক খাবার খায় নি। শুধু কাচিক ন্যায়ম নামে এক গাছের পাতা তার পেটে। অবিশ্বাস্য প্রান শক্তি যোগায় এইপাতা।
যাই হোক ডুনোর বীরত্বে লেপচারা আরো উদ্বুদ্ধ হল। প্রত্যেক মূহুর্ত ওরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকত। শোনা যায় রাতে ওরা ঘুমাতো হাঁটুতে বুক রেখে এবং হাতে তলোয়ার নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের হটিয়ে লেপচারা সমতলে নেমে এল।
সমতলে নেমে লেপচারা মুখোমুখি হল ইংরেজ সেনাবাহীনির পঞ্চম পাঞ্জাবী রেজিমেন্টের। আবার এক নতুন যুদ্ধ। লেপচা কম্যান্ডার আদুপে দোলে চিত্‍কার করে বললেন 'শ্যালিগ্রি' - 'ধনুকে ছিলা পরাও'। সেই থেকে জায়গাটার নাম হয়েগেল শ্যালিগ্রি। তারপর শিলগুড়ি আর এখন শিলিগুড়ি।
এ পর্যন্ত বলে তাকিয়ে দেখি শুধু মেয়ে আর তার মা নয় আসে পাশের দু-একটি মুখ বেশ উত্‍সুক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মধ্যে এক ভদ্রলোক বললেন - আচ্ছা দাদা এই গল্পটা কি সত্যি ? আমি বললাম - সত্যি মিথ্যে জানিনা তবে যা পড়েছি তাই মেয়েকে শোনাছিলাম।
পরদিন সকালে একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম মিরিকের উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে সুখিয়া পোখরির কিছুটা আগে এসে আটকে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে সামনে কি হয়েছে দেখতে গেলাম। দেখলাম ভারতীয় সেনাবাহীনির ট্রাক একটি যাত্রীবাহী টাটাসুমো গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে। যদিও রাস্তার আয়তন খুবই সঙ্কীর্ন তবুও লোক মুখে শুনে যেটুকু বুঝলাম সেনা ট্রাকের অসাবধানতাতেই এই দূর্ঘটনা। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম সেই ট্রাকের সেনারা নেমে এসে অকথ্য ভাষায় টাটাসুমো গাড়ির চালককে ধমকাচ্ছে। আমার মনেপড়ে গেল 2012 সালে আমরা গ্যাংটক থেকে নাথুলা যাচ্ছিলাম, 
পথে আমাদের গাড়ি সেনাবাহীনির একটি গাড়ির মুখোমুখি চলে আসে। সেই সেনারা আমাদের গাড়ির চালককে কিছু বলাতো দূরের কথা নিজের নেমে এসে সেনাবাহীনি গাড়িটিকে পিছিয়ে নিয়েগিয়ে আমাদের গাড়িটিকে পার হতে সাহায্য করল। এই দুই জায়গায় একই সেনাবাহীনির এই বৈপরীত্ব আমাকে খুব অবাক করল। যাইহোক স্থানীয় লোকেদের মধ্যস্থতায় সেই সময় ঝামেলা মিটল। আবার আমাদের গাড়ি এগোতে লাগল। সেইদিন মিরিক যাওয়ার পথে চা-বাগান, চা- গাছের ফুল দেখে আমার মেয়ে আত্মহারা। সেখানে অগত্যা কিছু সময় ব্যয় করতেই হলো। ফটো সেশনও হলো কিছু।
মিরিক যাওয়ার পথে চা বাগান
   
চা গাছের ফুল
                                                                                                                                                   তারপর পৌঁছালাম মিরিক লেক। একদশক আগে যে লেক দেখে গিয়েছিল তার সাথে আজকের মিরিক লেকের বিন্দুমাত্র মিল পেলাম না শুধু লেকের আকার আয়তন একই আছে। তখন মিরিক লেক সাজানো গোছানো ছিল, ছিল ফুলের বাগান। আজ আর কিছু নেই , শুধু চারিদিকে ইঁট কাঠের জঙ্গল, লেকের আসেপাশে অগুন্তি হোটেল আর রকমারি জিনিসের পশরা। প্রকৃতি এখানে ধর্ষিতা। আমার ভালোলাগল না। ফেরার পথে নেপাল বর্ডারে পশুপতি মার্কেট ঘুরে সন্ধ্যেবেলা চা হাতে আবার সেই ম্যালের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। মেয়েও সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে একটু ক্লান্ত, চুপকরে আমার পাশে বসে আছে। আর এক পাশে আমার সহধর্মিনী । মিরিক থেকে ফেরার পথেই গাড়ির চালকের সাথে আগামীকালের ঘোরার পরিকল্পনা পাকা করে নিয়েছি। আর আগামী পরশুদিনটা হাতে রেখেছি সারাদিন শহরটাকে পায়ে হেঁটে চেনার জন্য । আসলে কোন জায়গায় এসে যদি পায়ে হেঁটে ঘোরা না হয় তাহলে আমার মনেহয় সেই জায়গাটাকে, সেই শহরটাকে ঠিক জানা হল না। এব্যাপারে আমার স্ত্রীও আমার সাথে একমত। সেই পায়ে হেঁটে ঘোরার আলোচনাই করছিলাম স্ত্রীর সাথে। আর মনে মনে নিজের থেকেই মেয়েকে গল্প বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাত্‍ আগের দিনের সেই ভদ্রলোক এসে হাজির।
- কি দাদা আজ মেয়েকে কি গল্প শোনাবেন ?

দার্জিলিং  ম্যালে আমি
আমি মনে মনে ভাবলাম যাক এতদিন যা ছাইপাঁশ পড়েছি তা আসর জমানোর জন্য বেশ কাজে লাগছে দেখছি। মনটা বেশ খুশি হয়েগেল। কারণ সেই ছাত্র অবস্থায় অনেকেই বলত - নিজের পড়ার বই ছেড়ে কি যে সব ছাইপাঁশ পড়িস কে জানে ! 
ভদ্রলোককে মুখে বললাম না সেরকম কিছু না। এই ভাবছিলাম আরো দু-একটা জায়গার নামের উত্‍পত্তি নিয়ে মেয়েকে গল্প শোনাব। এই যেমন কার্সিয়াং - এটাও কিন্তু একটা লেপচা শব্দের বিকৃত রূপ। মেয়ে এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। বলল এটাও অন্য শব্দ থেকে এসেছে ! 
হ্যাঁরে মা , মূল শব্দ হল 'কার্সাং'। যার মানে হল 'ভোরের উজ্জ্বল তারা' - শুকতারা। নেপালিরা বলল খার্সাং আর ইংরেজরা ওটাকে বানালো কার্সিয়াং । 
- আচ্ছা বাবা এই দার্জিলিংটাও কি এরকম ভাবেই হয়েছে ?
- হ্যাঁ রে মা ঠিক ধরেছিস। এটাও একটা লেপচা শব্দ থেকে এসেছে।আসল শব্দ হল 'দার্জ্যুলাঙ্গ' যার মানে ভগবানের বাসস্থান। পৃথিবীর স্বর্গ।এই যে চৌরাস্তা উপর অবজার্ভেটরি হিল দেখছিস এর উপরে সিকিমের ষষ্ঠ রাজা টেন্ডন নামগেল একটা মন্দির তৈরী করে তার নাম দিয়েছিলেন 'দোর্জেলিং' মানে দোর্জের জায়গা। দোর্জে মানে বজ্র।
এবার মেয়ের প্রশ্ন - আচ্ছা তাহলে এই শহরটাও কি ইংরেজরা তৈরী করেছিল ?
বললাম হ্যাঁ তা বলতে পারিস, এটা ইংরেজদেরই তৈরী। তবে এই জায়গাটাও ইংরেজরা দখল করার জন্য কিছুটা কৌশল অবলম্বন করেছিল। সালটা ঠিক মনে পরছে না, খুব সম্ভবত 1827 সালে সিকিম ও নেপালের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে ঝগড়া আরম্ভ হয়েছিল।ঝগড়া মেটানোর জন্য ইংরেজ সরকারের কাছে আর্জি পেশ করা হল। জে.ডব্লু.গ্রান্ট নামে এক সাহেব এলেন মধ্যস্ততা করতে। এখানে এসে এখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া, ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েগেলেন। তিনি সেই সময়ের গর্ভনর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কে চিঠি লিখলেন যে অবিলম্বে এই অঞ্চল দখল করতে হবে। শুধু আবহাওয়া বা প্রকৃতিক সৌন্দর্য নয়, তিব্বত, নেপাল, ভুটান ও ভারতের উপর ক্ষমতা প্রসারের কেন্দ্র হিসাবে এর ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম।
এর প্রেমেই হয়তো মজে ছিলেনন গ্রান্ট সাহেব
ইংরেজ সরকার গ্রান্ট সাহেবের এই পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে সিকিমের সপ্তম রাজা শুকপুট নামগেল এর উপর চাপ দিল যাতে অর্থের বিনিময়ে দার্জিলিং পাওয়া যায়। এই নামগেল ছিল ভুটিয়া পরিবার। ইংরেজদের কূটনৈতিক জালে জড়িয়ে পড়ে রাজা তিনশো পাউন্ডের বিনিময়ে দার্জিলিং হস্তান্তরে সম্মত হলেন। লেপচা প্রজারা এই হস্তান্তর ভালো চেখে দেখল না। তারা রাজাকে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করল। প্রথম দিকে টাকাটা বাত্‍সরিক খাজনা হিসাবে ইংরেজদের কাছ থেকে নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু 1835 সালের পয়লা ফেব্রুয়ারী দার্জিলিংকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে ইংরেজ সরকার সেই চুক্তি নাকচ করে দিল। ইংরেজরা নামগেল প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি অবজার্ভেটরি হিল থেকে ভুটিয়া বস্তিতে সরিয়ে দিল। আর তাদের উচ্চারণ দোষে দার্জ্যুলাঙ্গ হয়েগেল দার্জিলিং।
দার্জিলিং নিয়ে ভ্রমন কাহিনী তো অনেক লেখা হয়েছে। তার মধ্যে কোথাও কোথাও এই গল্প পাঠক পাঠিকারা পেয়েও যেতে পারেন। আমিও এই গল্প বই পড়েই জেনেছি। সেটাই কিছুটা স্মৃতি থেকে মেয়ের সাথে সাথে আপনাদেরও শুনিয়ে দিলাম। তবে যে গল্পটা মেয়েকে বলিনি সেটা একটু বলি। এই যে বর্তমানে গোর্খাল্যান্ডের একটা ধুয়ো উঠেছে তা নিয়ে আমার সীমিত জ্ঞান থেকে দু-একটা কথা বলি। আজকের এই যে গোর্খাল্যান্ডের নামে আন্দলোন হচ্ছে তা কতটা যুক্তি সঙ্গত তা নিয়ে সন্দেহ একটু থেকেই যায়। গোর্খাল্যান্ড মানে হল গোর্খাদের আবাসস্থল।  আদতে গোর্খা বলে কোন জাতি কিন্তু ছিল না।
ইংরেজরা ভারত শাসন করার জন্য যে সেনাবাহীনি গড়ে তুলেছিল তার বিভিন্ন ভাগ ছিল। ছিল বিভিন্ন রেজিমেন্ট। সেগুলি আবার কিছু ক্ষেত্র প্রাদেশিক লোকজনদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল। সেই রকমই ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেদের নিয়ে ইংরেজরা যে রেজিমেন্ট গড়ে তুলেছিল তার নাম দিয়েছিল গোর্খা রেজিমেন্ট । হয়তো আমার এই গল্প সমন্বীত জ্ঞান ভুলও হতে পারে। তবে দেখতে গেলে দার্জিলিং এবং এর সংলগ্ন অঞ্চলের আদি অধিবাসী ছিল লেপচা জাতি। সেই সময় সিকিমের রাজাই ছিল এদের রাজা। ইংরেজরা দার্জিলিং দখল নেওয়ার পর নেপালীরা এখানে আসে। লেপচারা সরল সাধাসিধে কিন্তু কঠোর পরিশ্রমী ও লড়াকু জাতি। তবে বর্তমানে এদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। এরজন্য কিন্তু দায়ী তাদের এক বিশেষ সামাজিক প্রথা। এদের পরিবারের কোন বিবাহিত পুরুষ মারা গেলে তার স্ত্রীকে আবার বিয়ে দেওয়া হত। পাত্র হত মৃত পুরুষটির কোন অবিবাহিত ভাই। যদি ভাইদের বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ভাইপোদের সেই জায়গা নিতে হবে। ফল স্বরূপ বেশীর ভাগ সময়ই প্রৌঢ়ার সঙ্গে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত ছেলের বিয়ে হত। বিয়ের পর সেই প্রৌঢ়ার সন্তানদের এই ছেলেটিকে বাবা বলে মেনে নিতে হত। বেশীর ভাগ সময় প্রৌঢ়ার আর কোন সন্তান হতো না। আবার ছেলেটির এই প্রৌঢ়া স্ত্রী বেঁচে থাকতে দ্বিতীয় বিয়েরও অধিকার ছিল না। এইধরনের বাধ্যতামূলক জন্মনিয়ন্ত্রনের ফলে লেপচারা ধীরে ধীরে সংখ্যায় কমে এসেছে। এই ধরনের সামাজিক প্রথা হয়তো পারিবারিক সম্পত্তি রক্ষার জন্যই হয়েছিল। পরবর্তী কালে মিশনারীদের দৌলতে লেপচারা ব্যাপক হারে খ্রীষ্টান হয়ে যায়। কিন্তু তখনও এই প্রথা বন্ধ করা যায় নি। বর্তমানে শিক্ষার আলোকে এসে লেপচারা এই প্রথা বাতিল করলেও শুনেছি কিছু কিছু গ্রামে এখনও এই প্রথার প্রচলন আছে। 
যারা ভ্রমন কাহীনি পড়ার উদ্দেশ্যে আমার এই লেখা পড়বেন তারা হয়তো হতাশ হবেন। ভ্রমন কাহীনি লেখার জন্য বিশেষ চোখ ও মনের প্রয়োজন যা আমার নেই। শুধু কোন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সেই জায়গার টুকরো টুকরো ইতিহাস মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। আর বই পড়ার অভ্যেসের ফলে কিছু গল্প মনে পড়ে যায়। সেই গল্পটুকুই শুধু শোনালাম। পাঠক পাঠিকারা যদি হতাশ হয়ে থাকেন তাহলে সেই দায় সম্পূর্ণরূপে আমার।

মন্তব্যসমূহ

  1. কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে, সে জায়গায় রূপ রস বর্ণ গন্ধের সঙ্গে তার ইতিহাস না জানলে বোধহয় বেড়ানো সম্পুর্ন হয়না। মনে আছে, বহু বছর আগে, রাজগীর থেকে নালন্দা বিহার দেখতে যাবার সময় এক পর্যটক নিরস্ত করতে চেয়ে বলেছিলেন "নালন্দায় কি দেখবেন? সব ই তো ভাঙা ভাঙা"।

    এই লেখাটা একেবারে অন্যরকম একটা ভ্রমনকাহিনি। বাবা ও মেয়ের সুন্দর বন্ধন ধরা পড়েছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির সেই বড্ড সুন্দর অথচ হারিয়ে যেতে বসা বেড়াতে যাওয়া ধরা পড়েছে। অহেতুক রোমাঞ্চ তৈরি করতে গিয়ে অহেতুক বর্ননা নেই, আর অধ্যধিক বিষেশন ব্যবহার করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার চেষ্টা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও লেখার মধ্যে কোথাও যেন হিমালয়ের শান্ত সমাহীত অথচ ঋদ্ধ রূপটা ধরা পড়েছে।

    লেখায় তথ্য এসেছে অনেক, এবং এসেছে সাবলীল ভাবে। গল্পের হাত ধরে। ছোটোবেলায় বেড়াতে যাবার আকর্ষনের মধ্যে একটা প্রধান আকর্ষন ছিল, বাবার কাছে গল্প শোনা। এ লেখায় সেই জায়গাটা অনেক দিন পর আবার ফিরে পেলাম।

    খুব ভাল লেগেছে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস