অ-সম

মামণি তোমার আশ্রম চলে এসেছে।
- ও চলে এসেছে !
পর্ণা রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে একটা ২০ টাকার নোট বাড় করে।
- হরি কাকা এই নাও।
- কিন্তু মামণি আমার কাছে তো পাঁচ টাকা খুচরো হবে না। ঠিক আছে পরে না হয় শোধবোধ হয়ে যাবে।
- না হরি কাকা শোধবোধ করতে হবে না। তুমি পুরোটাই রেখে দাও।
পর্ণা আশ্রমের গেট খুলে ভিতরে চলে যায়।
বিঘা খানেক জায়গার উপর এই আশ্রম গড়ে উঠেছে। আশ্রম বলতে এটা কিছু অনাথ বাচ্ছাদের আশ্রয়স্থল।
পর্ণা প্রথম যখন এখানে দায়িত্ব নিয়ে আসে তখন এখানে বিশেষ কিছু ছিল না। অনাথ বাচ্ছাদের থাকার জন্য দুটো ঘর, একটা স্কুলঘর, আর বাচ্ছাদের ঘরের পাশে ছোট্ট একটা যেটাতে পর্ণা থাকে।
যিনি এই আশ্রমটি গড়ে তুলেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন শিশু নিকেতন। বর্তমানে এটি একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে চলে।
সুপ্রভা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সুপ্রভা সরকারের হাত ধরেই। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন আশ্রমের ওই ছোট্ট ঘরটাতেই থাকতেন যেটাতে এখন পর্ণা থাকে।
সুপ্রভাদেবীর মৃতযুর পর ওনার ছেলে এই ট্রাস্ট তৈরী করে দিয়েছেন যাতে আশ্রমের কারও কোন আর্থিক অসুবিধা না হয়।
পর্ণা প্রথম যেদিন এখানে আসে এই হরি কাকার রিক্সাতেই স্টেশন থেকে এসেছিল।
বাবা-মা তাকে ছাড়তে চায়নি। কিন্তু পর্ণার জেদের কাছে তারা হার মেনে নিয়েছিল।
খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে সে আবেদন করেছিল। ইন্টারভিউ হয়েছিল কলকাতায় সুপ্রভাদেবীর ছেলের অফিসে। ইন্টারভিউয়ের দিন ওখানে প্রার্থীর ভিড় নেহাত কম ছিল না। পর্ণা আশা করেনি যে সে এই চাকরীটা পেয়ে যাবে।
আশ্রমের চাকরীতে যোগ দেওয়ার পর বেশ কিছুদিন এই এলাকার লোকেরাতো বটেই, আশ্রমের বাচ্ছা গুলোও তাকে এড়িয়ে চলত। অবশ্য তার কারণও ছিল। পর্ণার বাঁদিকের চোখের নিচ থেকে গলা পর্যন্ত বিভৎস পোড়া দাগ।
মাস খানেক এভাবে চলার পর ধীরেধীরে আশ্রমের বাচ্ছারা তাকে আপন করে নেয়। সে হয়ে ওঠে তাদের মামণি।
প্রথম দিকে আশ্রমের স্কুল বলতে ছিল একটা ঘরে বাচ্ছাদের পড়ার ব্যাবস্থা। পর্ণা আর একটি ও আর একটি স্থানীয় মেয়ে বাচ্ছাদের পড়াতো। পড়ানো ছাড়াও বাচ্ছাদের সমস্ত দেখাশোনার ভারছিল পর্ণার উপর।
আজ তিন বছর পর আশ্রমের পুরো চেহারাটাই পাল্টে গেছে। এখন আশ্রমে থাকার জায়গা বেড়েছে, নতুন স্কুল বিল্ডিং তৈরী হয়েছে, শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যাও বেড়েছে। সাথে সাথে বেড়েছে আশ্রমিকের সংখ্যাও। এইসব কিছুর পিছনে রয়েছে পর্ণার আন্তরিক প্রচেষ্টা। এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে এই আশ্রমের জন্য অনুদান আসে।
কি গো কি ছাইপাঁশ ভেবে চলেছ তখন থেকে  ?
পর্ণা ঘুড়ে তাকায়।
- ও রাধু দিদি  ! তুমি কখন এলে  ?
- গেলাম কখন যে আসব. ! বলি স্নান খাওয়া কিছু করবে না এভাবেই বসেবসে বেলা কাবার করবে !
না না তুমি খেতে দাও আমি এখুনি স্নান সেরে আসছি।
রাধু দিদি এই ভদ্রমহিলার ভাগ্যটাও বড় অদ্ভুত। স্বামী সন্তান সব থাকতেও সে আজ এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছে। বলতে গেলে পর্ণাই তাকে এখানে তুলে এনেছে। স্বামী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পরে থাকে আর সন্তান,সেও বাপের পথের অনুসারি হয়ে মাকে ঘর থেকে বেড় করে দেয়। সেইদিন পর্ণা তাকে রাস্তার ধারে মলিন কাপড়ে বসে থাকতে দেখে এখানে নিয়ে আসে। তারপর থেকে সে পর্ণার রাধু দিদি আর আশ্রমের বাচ্ছাদের রাধুমাসি হয়ে এখানেই থেকে যায়। স্বামী সন্তানের শত অনুরোধ সত্ত্বেও আর ফিরে যায় নি।
পর্ণা স্নান সেরে বেড়িয়ে এসে দেখে রাধুদিদি খাবার বেড়ে বসে আছে।
- রাধু দিদি তোমার খাবার কই ?
- তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।
- না তোমারটাও বেড়ে আনো,দুজনে একসাথে বসে খাবো।
- তুমি এত জেদি কেন বলতো ?
- কি করবো বলো ! এটুকুই তো আমার সম্বল।
- ওফ, তোমার সাথে কথায় পারা যাবে না।
রাধু দিদি গজগজ করতে করতে নিজের খাবারের থালাটা নিয়ে আসে।
- নাও এবার গিলে আমাকে উদ্ধার কর।
- কি ব্যাপার গো দিদি ? আজ এত রাগ কিসের ?
- আচ্ছা কি দরকার বলতো মামণি এত কাজ করে ? সারাদিন তো এই আশ্রমের জন্য খাটছ। তার মাঝে আবার এই কলেজে যাওয়ার কি দরকার ?
- ওখানে আমার আরো কতগুলো ছেলেমেয়ে আছে গো দিদি, তারাও যে আমার পথ চেয়ে থাকে।
- বুঝি না বাপু এত কাজের কি দরকার !
- ও তোমায় বুঝতে হবে না।
এই দুপুরে ঘন্টাখানেক কিছুটা অবসর পায় পর্ণা। খাওয়ার পর তার এই ছোট্ট ঘরের খোলা জানলার পাশে এসে বসে। ভাবে, নাঃ সতযি সত্যি রাধু দিদি তাকে বড় বেশী ভালোবাসে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ করার সুবাদে গতবছর হঠাৎ করেই কলেজের পার্টটাইম লেকচারারের পদে কাজটা পেয়ে যায়। আশ্রমের ট্রাস্টের তরফে একটু আপত্তি ছিল কিন্তু তার অনমনীয় জেদের কাছে তারাও হার মানে।
- মামণি
- ও রাধু দিদি, তোমার সব কাজ সারা হলো ?
- হ্যাঁ এই সব শেষ হলো।
- এসো, আমার কাছে এসে বসো। বলো কি বলবে।
 - কাল তো শনিবার। তা কাল কি তুমি মায়ের কাছে যাবে ?
- হ্যাঁ, ভাবছিলাম কাল একবার মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি। রবিবার সকালেই চলে আসবো।
- তাই যাও। অনেকদিন তো হয়েগেল মায়ের কাছে যাও নি।

বাড়ি থেকে একরকম জোর করেই সে এই আশ্রমে চলে আসে। তারপর অভিমান বসত প্রায় এক বছর বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখেনি পর্ণা। হঠাৎই একদিন বাবা আশ্রমে এসে হাজির হন। বললেন মায়ের জন্য একবার বাড়ি ফিরে চল। তুই চলে আসার পর প্রত্যেকদিন বিকালবেলা নিয়ম করে সে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, যদি তুই আসিস। ইদানিং সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে যায় তবু সে ঘরে আসতে চায় না। তুই একবার চল না হলে যে তোর মাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারব না।
প্রায় একবছর পর সে বাবার সাথে বাড়ির পথ ধরে।
এখন নিয়ম করে না হলেও মাঝে মধ্যে বাড়ি যায়।
পর্ণা ভাবে, সত্যি অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি। কাল একবার মায়ের কাছ থেকে ঘুরেই আসি।

- হ্যাঁ রে পর্ণা তুই কি আর বাড়ি ফিরবি না  ? ওই আশ্রমেই থেকে যাবি ?
- মা, ওই আশ্রমই যে এখন আমার সব। ওখানের ছোটছোট বাচ্ছাগুলো আমার আশায় বসে থাকে। আমার কলেজ রয়েছে। আর তাছাড়া আমি তো বাড়িতে আসবই।
- কিন্তু এভাবে তুই সারা জীবন কাটাবি কি করে !
- এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে মা ! আর জীবন কখন কোথায় নিয়ে যাবে তা কি কেউ বলতে পারে !
- তাই বলে আমরা তোকে এই অবস্থায় চুপচাপ দেখে যাব ?
- আচ্ছা মা, আজ তোমার কি হয়েছে বলতো ? হঠাৎ এইসব কথা আসছে কেন ?
- হঠাৎ আবার কোথায় ? আমার মনে হলো তাই তোকে বললাম।
- না, নিশ্চই কোন কারণ আছে। সত্যি করে বলতো কি হয়েছে ?
- না মানে দিন কয়েক আগে সুমন্ত এসেছিল।
- কে এসেছিল ?
পর্ণা চিৎকার করে ওঠে।
- না পর্ণা তুই উত্তেজিত হোস না মা।
- ওর সাহস কি করে হয় এবাড়িতে আসার ! এরপর যদি ও এবাড়িতে আসে তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড় করে দিও।
- ঠিক আছে ঠিক আছে তুই একটু শান্ত হয়ে বোস মা।
- মা একটা কথা পরিস্কার শুনে রাখো, আমি যেমন আছি খুব সুখে আছি, শান্তিতে আছি। আর দ্বিতীয়দিন যদি তোমরা এইসব বলো তো সারাজীবনের মতো আমি বাড়ি আসা বন্ধ করে দেবো।
পর্ণা নিজের ব্যাগ তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। বাবা এসে বললেন -
- মা আজকের দিনটা থেকে যেতে পারতিস।
- বাবা আজ আমাকে থাকতে বলো না। আমি আবার আসব।
রাতের বেলা রাধু দিদি খাওয়ার জন্য জোর করেছিল কিন্তু পর্ণার আজ আর কিছু ভালো লাগছিল না। সে চুপচাপ জানালার ধারে বসে রইল।
সত্যি মানুষের ভাগ্য আর জীবন কি করে যে এইরকম এলোমেলো হয়ে যায় কে জানে ! অথচ কলেজের শুরু থেকেই বন্ধুমহলে বেশ জনপ্রিয় ছিল পর্ণা। তথাকথিত সুন্দরী সে নয় তবে অবশ্যই সুশ্রী আর তার সাথে ছিল আকর্ষনীয় ব্যেক্তিত্ব। গানে আবৃত্তিতে মাতিয়ে রাখত বন্ধুমহল।সুমন্তর সাথে তার সখ্যতা বন্ধু হিসাবেই। কিন্তু কলেজের অন্তিম লগ্নে এসে অনুভব করল যে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছে। অন্তত পর্ণার অনুভুতি সেই রকমই ছিল।
শুধু কলেজেই নয় পর্ণা জনপ্রিয় ছিল তার পাড়াতেও। পাড়ার ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক কাজ সবেতেই তার উৎসাহ ছিল চোখে পরার মত। তাই পাড়াতেও তার কিছু গুণগ্রাহী ছিল। তাদের মধ্যে রঞ্জন ছিল পর্ণার সমবয়সী ও এক সময়ের সহপাঠি। উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে পুরোদমে রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়ে ছিল রঞ্জন। দু-একবার হাবেভাবে সে প্রেম নিবেদন করতে চেয়েছিল কিন্তু পর্ণা সেভাবে পাত্তা দেয় নি। সে তখন সুমন্তর প্রেমে মশগুল।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে রঞ্জন পর্ণার পথ আটকিয়ে প্রেম নিবেদনের চেষ্টাও করে কিন্তু পর্ণা সরাসরি না বলে দেয়। পর্ণার চলে যাওয়া পথের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে রঞ্জন।
কলেজের পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাসখানেক পর সুমন্তর সাথে দেখা করে ফিরছিল পর্ণা। ততদিনে তাদের দুজনের বাড়িতে এই সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছে ও মেনেও নিয়েছে। সেদিন সে যেন হাওয়ায় ভাসছিল। সুমন্ত সরকারী অফিসে একটা কেরাণীর চাকরী জুটিয়ে নিয়েছে। সংসার পাতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাড়ি ফিরছিল পর্ণা। হঠাৎ রাস্তার ধারে বাইক নিয়ে রঞ্জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। পর্ণা রঞ্জনকে এড়িয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে যেতেই রঞ্জন বাইক স্টার্ট দিয়ে পর্ণার বাঁ-পাশ দিয়ে ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে যায়। পর্ণা চিৎকার করে মুখ চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর তার আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফেরে, সে তখন হাসপাতালের বিছানায়। দেখে মা পাশে বসে আছে আর পায়ের দিকে সুমন্ত দাঁড়িয়ে। সারা মুখে অসহ্য যন্ত্রনা। ডাক্তার বলে অল্পের জন্য তার বাঁ চোখটা রক্ষা পেয়েছে। বাঁ চোখের নিচ থেকে গলা পর্যন্ত বিভৎস ক্ষতচিহ্ন রেখেগেছে রঞ্জনের ছুঁড়ে দেওয়া অ্যাসিড।
বাড়ি ফেরার পর নিজেকে গুটিয়ে ফেলে পর্ণা। এভাবেই কেটে যায় একটা বছর। এই এক বছরে সুমন্ত সব সময় তার পাশে ছিল। ওর কথাতেই পর্ণা এম এ তে ভর্তি হয়। পর্ণা যখনই আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় সে ভাবে সুমন্ত তাকে অনুকম্পা করছে না তো !
এর মধ্যে অনেকবার পর্ণা সুমন্তকে বলেছে যে তুমিতো এখন সাবলম্বী হয়েগেছ, এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করো। সুমন্ত কোন জবাব না দিয়ে শুধু হেসেগেছে।
যেদিন পর্ণার এম এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়লো সেদিন সন্ধ্যেবেলা সুমন্ত এসেছিল। যাওয়ার সময় পর্ণাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, বিয়ে করবে আমায় ?
সেদিন সারারাত ভেবেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি পর্ণা। সুমন্তর মা-বাবারও এই বিয়েতে সেভাবে সম্মতি ছিল না। কেই বা আর পোড়া মুখের মেয়েকে নিজের পুত্রবধু হিসাবে মেনে নিতে চায়! কিন্তু সুমন্তর জেদের কাছে হার মানে সবাই। একমাসের মাথায় পর্ণাদের বাড়িতে বেজে ওঠে বিয়ের সানাই।
ফুলসজ্জার রাতে সুমন্ত পর্ণাকে বলে - আজ আমি খুব ক্লান্ত, কাল তোমার সাথে গল্প করব কেমন। বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে পড়ে সুমন্ত। অপর পাশে রাত জেগে বসে থাকে পর্ণা কালের অপেক্ষায়। কিন্তু সে কাল আর আসে না।
প্রত্যেকদিনই অফিস থেকে রাত করে বাড়ি ফেরে সুমন্ত। বিয়ের পর আলাদা ফ্ল্যাটে পর্ণাকে নিয়ে চলে এসেছিল সুমন্ত। তাই সারাদিন একাই কেটে যায় পর্ণার। এই বন্দী জীবন অসহ্য লাগে তার। বিয়ের তিনমাস পেরিয়ে গেলেও পর্ণাকে ছুঁয়েও দেখেনি সুমন্ত। প্রত্যেকদিন ক্লান্তির অজুহাতে ঘুমিয়ে থাকা সুমন্তর দিকে তাকিয়ে ভাবে কেন সুমন্ত তাকে বিয়ে করল ! সে তো কখনও সুমন্তর কাছে তাদের ভালোবাসার পরিনতি দাবী করে নি। আর যদি বিয়েই করল তবে কেন এই অবহেলে  !
সেদিন সুমন্ত অফিস বেড়ানোর সময় পর্ণা বলে
- অনেকদিন বাইরে কোথাও যাই নি। আজ আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবে ? কোন রেস্টুরেন্টে  ?
- ঠিক আছে তুমি তৈরী হয়ে থেকো আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।
কখন সন্ধ্যা হবে সেই অপেক্ষায় পর্ণার সারাদিন কেটে যায়। সন্ধ্যার আগেই সে তৈরী হয়ে বসে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েগেলেও সুমন্ত ফেরে না। অনেক রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে সুমন্ত। পর্ণা আর চূপ থাকতে পারে না, রাগে ফেটে পড়ে।
- আগে তো কখনও আমার জন্মদিন ভুলতে না! আজ সারাদিনেও তোমার মনে পড়ল না এই দিনটার কথা ! সেটাও না হয় আমি মেনে নিলাম। তোমার সাথে আমি বাইরে যেতে চাইলাম কিন্তু তুমি আশা দিয়েও এলে না। এত রাতে মদে চুড় হয়ে ফিরলে ! কেন বলতে পারো?
- কেন ? আমায় জিজ্ঞাসা করছ ? আমাকে প্রশ্ন না করে নিজে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।
- মানে ?
- মানেটা খুব সহজ। তোমাকে নিয়ে জনসমক্ষ্যে বেড়োনো যায় না। আমার পাশে তুমি বেমানান।
- তুমিতো সব কিছু জানতে। তাহলে আমায় বিয়ে করলে কেন ?
- মহান হতে চেয়েছিলাম। শালা মহানতার ভুত ঘাড়ে চেপে বসেছিল। একটা অসহায় নারীকে করুণা করতে চেয়েছিলাম। শ্রীযুক্ত বাবু সুমন্ত করুণার সাগর দয়ার সাগর .......
বিছানায় লুটিয়ে পড়ল সুমন্ত।
স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে পর্ণা। চোখে জল আসেনা, শুধু চোখ দুটো জ্বালা করে।
সেদিন ভোর হওয়ার আগেই ঘর ছেড়েছিল পর্ণা। ফিরেগিয়েছিল তার নিশ্চিন্ত আশ্রয় মা-বাবার কাছে। এক কথায় সুমন্তকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পর কেন আবার পর্ণার কথা মনে পড়ল তার ! চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে। বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে।
নিয়ম মাফিক দিন চলতে থাকে। আগের চেয়ে পর্ণার ব্যাস্ততা আরো বেড়ে গেছে। আশ্রম কলেজ সবদিক সামলাতা সামলাতে কখন যে দিন পার হয়ে যায় সে নিজেও টের পায় না।
সেদিন মায়ের কাছ থেকে ওভাবে চলে আসার পর তার নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল। তাই গতকাল মায়ের কাছে গিয়েছিল সে। না, মা আর সুমন্তর বিষয়ে কোন কথা বলে নি। আজ সকালে সে ফিরে এসেছে। স্নান সেরে ঘরে আসতেই রাধুদিদি এসে বলল
- মামণি, কাল তোমার একটা চিঠি এসেছে।
- ঠিক আছে তুমি অফিসের টেবিলে রেখে দাও আমি পরে দেখে নেব।
- অফিসের চিঠি নয় গো, তোমার নামেই এসেছে।
- আমার নামে ? কই দেখি  ?
রাধুদিদি চিঠিটা দিতে সে খামটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। কোথাও কোন পোষ্ট অফিসের ছাপ নেই। তাহলে কে দিয়ে গেল!
- রাধুদিদি চিঠিটা কে দিয়েগেছে জানো  ?
- না গো, চিঠির বাক্সে পড়ে ছিল আমি নিয়ে এসে রাখলাম। কেন কি হয়েছে  ?
- না কিছু না, তুমি যাও।
চিঠিটা খুলে চিঠির নিচে নাম দেখে পর্ণার মাথাটা গরম হয়েগেল। একবার ভাবল চিঠিটা না পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দেয় তারপর কি মনে হতে চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করল। ছোট দু লাইনের চিঠি -
" তোমায় সম্বধোন করার সাহস আজ আমার আর নেই। জানা তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। তবুও যদি সেই পুরানো রেস্টুরেন্টে আসো বড় ভালো হয়। তোমায় কিছু বলার ছিল। আগামী রবিবার বিকেলে আমি ওখানে অপেক্ষায় থাকব। -
               সুমন্ত
চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল পর্ণা। এতদিন পর কি চায় সে  ! কেন তাকে এভাবে বিরক্ত করছে  ! সে তো সব কিছু ভুলে নতুন ভাবে বাঁচতে চাইছে। তবে কেন !
পর্না ভেবেছিল তার সাথে আর দেখা করবে না। কি হবে দেখা করে।  কিন্তু পরে ঠিক করল দেখাই যাক না কি চায় ও।
রবিবার প্রায় সন্ধ্যে নাগাদ সেই পরিচিত রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকল পর্ণা। সবকিছু সেই একই রকম আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কোনার দিকে একটা টেবিলে সুমন্ত বসে আছে। এই তিন বছরে বয়সের থেকে অনেকটাই বুড়িয়ে গেছে সুমন্ত। পর্ণা ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল সুমন্ত, বলল
- বসো, কেমন আছো পর্ণা ?
- আমার কথা থাক। কেন ডেকেছ সেটা বলো।
বেয়ারা এসে দু কাপ কফি দিয়ে গেল।
- পর্ণা, তোমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পর আমি আবার বিয়ে করেছিলাম। আমার একটা ছেলেও হয়েছে।
- এসব আমাকে বলছ কেন ! এসব শুনে আমার কি লাভ ?
- না, লাভ নেই জানি। আসলে আজ আমি নিঃসঙ্গ।
- কেন ?
- সেদিন তোমায় আমি দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। আজ আমার স্ত্রী আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে।
- বাঃ ভালোই তো, আবার একটা বিয়ে করে নাও।
- আজ আমি বুঝতে পারছি কাউকে দূরে ঠেলে দিলে তার মনের কি যন্ত্রনা তাই আজ তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।
- শুধু ক্ষমা চাওয়ার জন্য এত দূরে আমাকে ডেকে নিয়ে এলে ! ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা। তা তোমার স্ত্রী চলে গেল কেন ?
- কেরাণী স্বামী তার আর পচ্ছন্দ নয়। সে আরও অভিজাত হতে চায়। আরও টাকা, আরও সম্পদ, আরও ক্ষমতা।
- সবারইতো নিজস্ব কিছু চাওয়া পাওয়া আছে এতে অন্যায় তো কিছু নেই।
- না কোন অন্যায় নেই।
- কিন্তু আমাকে ডাকলে কেন ? নতুন বৌ খুঁজে দেওয়ার জন্য না তোমার বৌ-ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য ?
- পর্ণা তুমি কি ফিরে আসতে পারো না ?
- সুমন্ত একদিন রাতের পর রাত তোমার একটু স্পর্শ পাওয়ার জন্য আমি অপেক্ষায় থেকেছি কিন্তু তুমি ছুঁয়েও দেখনি। তোমার কাছ থেকে একটা সন্তান পাওয়ার আশায় আকুল হয়েছি কিন্তু তুমি ফিরে চাওনি। তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে তুমি নিজের পায়ে মাড়িয়ে করুণার সাগর হতে চেয়েছিলে। তাই তো তুমি পেয়েছ। আমার কাছে মুক্তি চেয়েছিলে, তাও তোমায় দিয়েছি।  আরতো আমার কাছে তোমায় দেবার মতো কিছু নেই।
- জানি ওটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল।
- রঞ্জন আর তোমার মধ্যে পার্থক্য কোথায় জানো! রঞ্জন আমার বাইরের আবরণটা পুড়িয়েছিল তাই তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।  কিন্তু তুমি আমার মনটাকে জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিয়েছ তাই তোমার প্রতি আমার এতটুকু অনুভুতিও আর বেঁচে নেই।
পর্ণা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পথে পা বাড়ায়।
- পর্ণা  !
- জানো সুমন্ত, আজ আমার একটা নয় অনেক সন্তান, তাদের কাছে আজ আমি মামণি। কলেজে পর্ণা ম্যামকে সবাই শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে। আমি আজীবন সেইসব ছেলেমেয়েদের কাছে মামণি হয়ে, পর্ণা ম্যাম হয়ে বাঁচতে চাই। আজ তুমি আমার পাশে বড়ই বেমানান। আজ তোমাকে আর আমার পাশে মানায় না সুমন্ত।
হাতের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে যায় পর্ণা। তার আত্মতৃপ্ত দৃঢ় পদক্ষেপের দিকে সুমন্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়ে যায়।
------------------- সমাপ্ত ------------------

মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক অনেক অভিনন্দন এই লেখাটার জন্যে। এরকম লেখা লিখতে অনেকটা ইচ্ছে আর কলজের জোর লাগে। কেননা এ ধরনের লেখা তো আর পাঠকের মন রেখে চলে হাল্কা কিছু রগুড়ে লেখা নয়, এ লেখার তার আলাদা। অনেক কিছু ভাবিয়ে দিয়ে গেল এই ছোটো গল্প। খুব ভাল হয়েছে। শেষ টুকু একেবারে আকাশে তুলে দিয়েছে গল্পকে।

    উত্তরমুছুন
  2. মেদহীন গল্প আর ছোট ছোট কথোপকথন ফুটিয়ে তুলেছে চরিত্রের বিভিন্ন দিক। এরকম লেখা আরো চাই। কুরনিশ ভাই।

    উত্তরমুছুন
  3. বাপরে, প্লটটা দুর্ধর্ষ!! দারুণ লেখা - অনেকগুলো মোড় আছে, একটার পর একটা। আর, আমিও একমত, এরকম পরিস্কার সাহসী লেখার জন্যে একটা সেলাম। পড়তে খুবই ভালো লাগল। দারুণ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস