যারা লেখে

দীপাঞ্জন যখন বাস থেকে পাড়ার মোড়ে এসে নামল তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে। ক্লান্ত পা দুটো টেনে টেনে বাড়ির দিকের রাস্তা ধরল। বাড়িতে যাওয়ার ব্যাস্ততা নেই তার। বাড়ি ফেরা মানেই সেই নিত্য দিনের অশান্তি। অবশ্য দিশাকে দোষ দিতে পারে না। প্রত্যেকের মনেই কিছু ইচ্ছা কিছু চাহিদা থাকেই। দীপাঞ্জন জানে সে সেই চাহিদা পুরনে অক্ষম। দীপাঞ্জন আর বিদিশা দুজনে দুজনকে ভালবেসেই সংসার পেতে ছিল। ভালবেসেই তারা একে অপরকে দীপ আর দিশা নামেই ডাকতো। আজও সেই নামেই তারা সম্বোধন করে কিন্তু আগের সেই মাদকতা এই নামে আর খুঁজে পায় না তারা। আজ সংসারের চাপে এই নাম দুটি শুধুই অভ্যেস হয়ে গেছে। বরাবরই একটু রাত করে ঘুমানো অভ্যেস দীপের। বিয়ের প্রথম প্রথম দিশা অতটা বুঝতে পারেনি। তখন দুজন দুজনকে নিয়ে মাতোয়ারা। প্রেমের আবেশ যখন অভ্যেসে পরিনত হয় তখন দিশা দেখে দীপ প্রায় মাঝরাত করে বিছানায় আসে। প্রথমে ভেবেছিল দীপ হয়তো অফিসের কোন কাজে ব্যাস্ত থাকে। একদিন বইয়ের তাক গুছাতে গিয়ে নজরে পরে নীল রঙের একটা বাঁধানো খাতা। কৌতুহল বসত খাতা খুলে বসেছিল দিশা। পাতায় পাতায় ভরা স্বপ্ন ছবি। দীপের সৃষ্টি। ছোট ছোট কবিতা আর গল্পে ভরা। সযত্নে সঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছিল খাতাটি। দীপ জানতেও পারেনি। সেদিন রাতে দীপ ঘুমন্ত প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে খাতা খুলে বসেছিল। তারপর ডুবে যায় তার নীল স্বপ্নে। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শে তাকিয়ে দেখে প্রেয়সীকে। তাড়াতাড়ি খাতা বন্ধ করে বলে এইতো হয়েগেছে, চল আমি যাচ্ছি। দিশা পাশে এসে বসেছিল। দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলেছিল আগেতো কখনও বলনি আমায়। আমি কিন্তু চুরি করে তোমার লেখা পড়ে ফেলেছি। দীপ বলেছিল, আরে না না তেমন কিছু নয়। এটা আমার মনের খিদে। নিজের ভালোলাগায় লেখা। দিশা বলেছিল - আর আমি ? দীপ দুহাতে আলতো করে দিশার মুখ ধরে বলেছিল - তুমি আমার মন আর এই লেখা আমার মনের জানালা।
আজ আর সেই মনের তল খুঁজে পায় না দীপ।
আজ ফিরতে কিছুটা দেরীই হয়েগেছে। দরজার সামনে এসে বেল বাজাতেই দিশা দরজা খুলে দাঁড়ায়। দীপ দিশার চোখের দিকে তাকায় কিন্তু দিশার কোন অভিব্যেক্তি চোখে পরে না। আসলে দিশা জানে অফিসের কাজে মাঝেমধ্যে দীপের দেরী হয় । দীপ নিজের ঘরে অপরাধীর মতো প্রবেশ করে। সদ্য হামাগুড়ি দিতে শেখা তাদের সন্তান বিছানার উপর একটা পুতুল নিয়ে খেলছে। দীপকে দেখে অবোধ্য শব্দে কিছু একটা বলে ওঠে। দীপ অফিসের ব্যাগটা টেবিলে রেখে তাকে কাছে টেনে নেয়। অন্যদিন বাড়িতে ফিরেই চায়ের জন্য দিশাকে তাগাদা দেয় কিন্তু আজ আর কিছু ভালোলাগছেনা তার।
আজ অনেক আশা নিয়ে অফিস শেষে এক প্রকাশকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল দীপ। বেশ কদিন আগে নিজের লেখা একটা খসরা পাঠিয়েছিল এক প্রকাশকের কাছে। আজ সন্ধ্যেবেলা দেখা করতে বলেছিলেন সেই প্রকাশক। সন্ধ্যের সময় পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীপকে। প্রকাশক নাকি কোন এক জরুরি কাজে ব্যাস্ত আছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ডাক পরেছিল তার। প্রকাশক দীপের হাতে লেখার খসরা ফেরত দিয়ে বলেছিল, দেখুন দীপাঞ্জন বাবু এ লেখা বাজারে চলবে না। আপনি যা লিখেছেন তা পাবলিক খাবে না। আর আপনার মতো অখ্যাত লেখকের লেখা ছেপে আমি রিস্ক নিতে পারব না। তবে আপনি যদি খরচা দিতে পারেন তাহলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
দীপাঞ্জন চুপচাপ উঠে চলে আসে।
রাত গভীর হয়। নীল খাতার সাদা পাতার সামনে বসে থাকে দীপ। ভাবে পাবলিকে তাহলে কি খায় !


এই নিকষ কালো রাতে স্বপ্ননীড় অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচ তলার ডানদিকের ফ্ল্যাটে মৃদু আলোর রেখা ফুটে ওঠে। স্বামী সোহাগ শেষে অনুসূয়া, টেবিল ল্যাম্পের হালকা আলোয় নিজের প্রিয় ল্যাপটপ খুলে বসে। পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে দেখে নেয়। বিশ্বজিৎ গভির ঘুমে অচেতন।
এই বছর খানেক হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। বিশ্বজিৎ স্বামী হিসাবে খারাপ নয়। তাকে বেরসিকও বলা যায়না। কিন্তু নিজের কাজটুকু  ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহ নেই তার। বিয়ের আগে থেকেই একটু আধটু লেখার অভ্যেস ছিল অনুসূয়ার। তবে ছাপার অক্ষরে সে লেখা দেখার সৌভাগ্য হয়নি কোনদিন। তার এই লেখালেখির ব্যাপারে মায়ের কোন সায় ছিলনা কোনদিন । বলতো কি হবে ওসব ছাইপাঁশ লিখে । তার চেয়ে ঘরের কাজে মন দে। তার লেখার সবচেয়ে বড় গুণগ্রাহী তার বাবা। বাবার উৎসাহেই নিজের ব্লগে লিখতে থাকে অনুসূয়া। বাবা যতক্ষণ না তার লেখা পড়ছেন ততক্ষণ মনেহয় লেখাটা যেন অসম্পূর্ন রয়ে গেল। তার এই লেখার অভ্যেস বিশ্বজিতের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে সযত্নে । সে জানে যে বিশ্বজিৎ জানতে পারলে তাকে নিয়ে মশকরা করবে।
ফুলশয্যার রাতে বিশ্বজিৎ অনুসূয়ার মুখ দু-হাতে তুলে বলেছিল, কিছু বলো । অনুসূয়া বলেছিল -
" তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
  শতরূপে শতবার
 জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার "
বিশ্বজিৎ হা হা করে হেসে উঠেছিল।
বলেছিল - এটা কি ?
- এটা রবীন্দ্রনাথের 'অনন্ত প্রেম'
- দেখো, এইসব নেকুপুসু আমার ভালোলাগে না। ভাবের ঘরে বসবাস করে সময় নষ্ট করা বোকামি।
তাই অনুসূয়া কোনদিন নিজের লেখার কথা উচ্চারণ করেনি। নিজের ব্লগে নিজের সৃষ্টি ছরিয়ে দিতে থাকে। ল্যাপটপের নীল আলোয় নিজের মনের ছবি আঁকতে থাকে অনুসূয়া।


নিলোৎপল ভেবেছিল আজ অফিস থেকে  তাড়াতাড়ি ফিরে একটু লেখালেখি নিয়ে বসবে। অফিসে কাজের চাপও তেমন ছিল না আজ। কিন্তু তা আর হলো কোথায়। ওদের অফিসেরই দীপাঞ্জন দা হঠাৎ এসে হাজির। দীপাঞ্জন দা লোক হিসাবে মন্দ না। সেই কলেজ জীবন থেকেই পরিচয়। বলতে গেলে দীপাঞ্জন দার দেখাদেখি সেও কলেজ ম্যাগাজিনে লিখতে আরম্ভ করে। ম্যাগাজিন বলতে হাতে লেখা একটা দুপাতার দেওয়াল পত্রিকা। দীপাঞ্জন দা সামনের চেয়ারে বসে বলল -
-   আচ্ছা নীল, ব্লগ কি করে তৈরী করে তুমি জানো ?
-  ব্লগ ?
- হ্যাঁ আসলে অনেকের কাছে শুনেছি তাই আর কি।
-  দীপাঞ্জন দা তুমি এখনও লেখ ?
- ওটা যে নেশা ভাই ছাড়ি কেমন করে?
- তুমি লিখবে ব্লগে?
- শুনেছি এখন নাকি অনেকেই লেখে, পড়েও অনেকে তাই ভাবলাম।
- আমি তোমায় বানিয়ে দেব ব্লগ।
- আচ্ছা ব্লগে মোবাইল থেকে লেখা যাবে।
- হ্যাঁ হ্যাঁ যাবে যাবে।
-না আসলে এই সব সম্বন্ধে আমার কোন ধারনা নেই। আমার দৌড় ওই ইমেল পর্যন্ত।
- কিন্তু ব্লগের তো একটা নাম দিতে হবে। কোন নাম ঠিক করেছো ?
- নাম ?
- হ্যাঁ, নাম ছাড়া অন্যরা তোমায় খুঁজে পাবে কি করে !
- বেশ, তাহলে নাম দিও ' মনের জানালা '।
- তুমি একটু বসো আমি তৈরী করে দিচ্ছি।
- আচ্ছা নীল তুমি লেখ না ?
- লিখতে তো ইচ্ছা করে কিন্তু কাজের চাপে হয়ে ওঠে না। জানো দীপাঞ্জন দা এক এক সময় মাথার ভিতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছটপট করে। কালো শব্দ গুলো মনের সাদা পাতায় ছুটে বেড়ায় কিন্তু কাজের চাপে বেঁধে রাখতে পারিনা। কাজে আর মন বসে না। মনেহয় সব ছেড়ে পালিয়ে যাই।
- নিজের জন্য একটু সময় বের করো নীল দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

দীপাঞ্জন দা চলে যাওয়ার পর নীল ভাবে সত্যি এবার নিজের জন্য সময় বার করতে হবে। তাই আজ সময়ের আগেই বাড়ি ফিরেছে সে। তার শত ব্যস্ততার মাঝে একমাত্র মুক্ত হাওয়া  তন্দ্রা। কলেজ জীবন থেকেই তাদের সম্পর্ক। অফিস জয়েন করার পর দেখা সাক্ষাত বিশেষ হয় না ওই সপ্তাহে একটা দিন ছাড়া। বাকূ দিনগুলোতে ভরসা শুধু মুঠো ফোন। ফোন করলে প্রত্যেকবার সব কথার শেষে একটাই কথা - নীল তুমি কতদিন কিছু লেখ না। নীলেরও একটাই জবাব - সময় পাই না যে, তুমি তো জানো তন্দ্রা অফিসের কত চাপ।
কিন্তু আজ দীপাঞ্জনদার কথাটা যেন মনটাকে ছুঁয়ে গেছে। টেবিলে বসে সাদা পাতায় শব্দ গুলো ধরার চেষ্টা করে নীল। নিজের জন্য সময় বার করতেই হবে।
কদিন অসহ্য গরমের পর আজ দুপুর বেলা থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা। অফিসের জানলা দিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল নীলোৎপল। কাল রাত থেকেই মনটা খারাপ। তন্দ্রা এক এক সময় এমন জেদ ধরে যে বলার নয়। গতকাল সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে সবে মাত্র বেড়িয়েছে নীল, হঠাৎ তন্দ্রার ফোন - 
- এই কোথায় আছো তুমি ? 
- এইতো অফিস থেকে বেরলাম। 
- এখনি চলে এস। 
-  কোথায় যাব এই সন্ধ্যেবেলা ? 
-  কেন সন্ধ্যেবেলা বলেকি তোমার সাথে বেড়াতে যেতে নেই ! আরে এখনইতো বেড়ানোর সময়। 
- তন্দ্রা আজ হবে না, আজ থাক।
- কেন আজ হবেনা কেন?
- তুমিতো জানো সোনা, অফিসের পরও আমার কিছু কাজ থাকে, আর তাছাড়া কাল বাদে পরশু তো রবিবার আমরা তো দেখা করছিই না কি ? 
- তোমার না আছে আমার জন্য সময় , না আছে তোমার নিজের জন্য সময়। এভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে লাভ কি নীল ! তার চেয়ে তুমি তোমার কাজ নিয়েই থাকো। 
ফোনটা কেটে দেয় তন্দ্রা। নীল ফোন করার চেষ্টা করে কিন্তু তন্দ্রার কাছ থেকে কোন সারা পায় না। নীল জানে রাগ কমলে তন্দ্রা নিজেই আবার ফোন করবে।  
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অফিস ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ায় নীল। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখে  কোনের দিকের টেবিলে এক কাপ চা নিয়ে চুপ করে বসে আছে। নীল কাছে গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে মুখমুখি বসে জিজ্ঞাসা করে -
- দীপাঞ্জন দা কি খবর তোমার ? ব্লগে লেখাললেখি কেমন চলছে ? 
- নীল তোমায় কি বলে যে ধন্যবাদ দেব জানিনা। সত্চি বলছি, ব্লগে লেখার পর কতজনের কত রকম মতামত পেলাম। আমার লেখা যে আরও অনেকের কাছে পৌঁছাচ্ছে আমি ভাবতেও পার ছি না। 
- তুমি যে বড় ভালো লেখ দীপঞ্জন দা। 
- আমার কথা বাদ দাও। তুমি কিছু লিখলে ? 
- না দাদা, এখনও সময় করে উঠতে পারি নি। 
- দেরী করো না নীল, নিজের জন্য সময় বের করতে না পারলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে যে।
অফিস থেকে নীল যখন বেড়লো তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ি ফিরে সোজা নিজের টেবিলে গিয়ে বসল নীল। সামনে সাদা পাতা, কালো শব্দ গুলো ধরার জন্য হাত বাড়াল নীল। 
হঠাৎ মোবাইলের শব্দে চমক ভাঙলো। প্রেয়সী ডাকছে তাকে।
- হ্যাঁ বল তন্দ্রা ! 
- খাওয়া হয়েছে ? 
- না, এখনও হয়নি। 
- কটা বাজে সে খেয়াল আছে ! রাত এগারোটা এখন । 
- না, মানে খেয়াল করিনি আসলে। 
- তা করবে কেন ? তোমার কাছে তোমার কাজ ছাড়া আর কিছুই নেই যে । 
- না তন্দ্রা, নিজেকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। 
- মানে ? কি যাতা বলছ ! 
-  অনেকদিন পর আবার
খুঁজতে গেলাম তাকে। 
অনেকদিন হয়নি নেওয়া
তার কোন খোঁজ, 
দরজাতে আগল তুলে
আমি বসেছিলাম শুধু। 
কতকাল পেরিয়ে গেছে 
টের পাইনি কোন। 
সহসা আগল ভেঙে
দরজা গেল খুলে, 
আলোর ছটার ঝলকানি, 
চোখে বোবা অনুভুতি। 
হাতরে বেড়াই চতুর্দিকে, 
ভাঁড়ার খালি, আমায় ছেড়ে 
মন গিয়েছে চলে। 
- থাক নীল , আজ থাক। কাল সূর্যাস্তের আলোয় তোমার কোলে মাথা রেখে দুজনে মিলে খুঁজব তোমার হারিয়ে যাওয়া মনটাকে। 


ল্যাপটপের নীল আলোর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে অনুসূয়া। সারা শরীরে জড়িয়ে আছে যে অপমান, চুঁয়ে পড়ছে চোখের জলে। মনের গভীরে শুধু একটাই প্রশ্ন। কেন?  কেন?  কি আমার অপরাধ ? 
আজ এই ফ্ল্যাটে সে একা। মাতাল বিশ্বজিৎ কে সাথে নিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করেনি সে।
অথচ আজ সকালের শুরুটা বেশ সুখকর ছিল। বেলা বাড়তেঊ শুরু হল আকাশে মেঘের আনাগোনা। আজ আর বিশ্বজিৎ অফিসে যায় নি।  আজ সন্ধ্যেবেলা অফিসের একটা গেটটুগেদার পার্টি ছিল। দুপুর থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বিশ্বজিৎ তখন ভাত ঘুমে আচ্ছন্ন।  নিজের ল্যাপটপটা খুলে বসে অনুসূয়া। সাধরনত বিশ্বজিৎ বাড়িতে থাকলে অনুসূয়া এইসব লেখালেখি থেকে দূরে থাকে। বিশ্বজিৎ যখন অফিসে থাকে, সেই নির্জন দুপুরে বা নিশুতি রাতে সে তার মনের আবেগ ফুটিয়ে তোলে তার লেখাতে। কিন্তু আজ কি জানি কেন এই বৃষ্টি ভেজা দুপুরে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়েছিল তার। নিজের ল্যাপটপে মগ্ন ছিল সে। হঠাৎ হাসির আওয়াজে চমক ভেঙে তাকিয়ে দেখেছিল বিশ্বজিৎ পিছনে দাঁড়িয়ে, চোখ ল্যাপটপের স্ক্রীনে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অনুসূয়া। তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। বিশ্বজিৎ তার চোখে চোখ রেখে বলে -
- ইচ্ছে ডানা !  নামটাতো বেশ দিয়েছ।
- ব্লগের তো একটা নাম দিতেই হয় তাই।
- ব্লগ ! হা হা হা, তা ইচ্ছে ডানায় ভর দিয়ে কোথায় উড়ে যেতে চাও ?
- মানে ?
- বেশী উড়তে যেও না সুন্দরী, ডানায় আঘাত লাগতে পারে।
- কি বলতে চাইছ তুমি?
- কিছু না । তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। পার্টিতে যেতে হবে।
বৃষ্টির জন্য পার্টিতে যেতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গিয়েছিল। অফিস পার্টি বলে কথা তাতে সুরা থাকবে না তা কি হয়! এমনিতে বিশ্বজিৎ মদ খায়না, তবে পার্টিতে এলে একটু আধটু খায় বইকি। আজ যেন একটু বেশীই বেসামাল ছিল বিশ্বজিৎ। অনুসূয়া দুএকবার বারণ করেছিল কিন্তু তার কথার পাত্তা দেয় নি বিশ্বজিৎ। অনুসূয়া একটা সফ্ট ড্রিংকস নিয়ে মেয়ে মহলে জমে ছিল। বিশ্বজিৎ এর বসের স্ত্রী অঞ্জুদি বেশ অমায়িক ভদ্রমহিলা। প্রথম যেদিন আলাপ হয়েছিল সেদিন থেকেই অনুসূয়ার সাথে বেশ বন্ধুত্ব। আসর জমাতে পারেন বেশ ভাল। অনুসূয়াকে অনু বলে ডাকেন।  মহিলা মহলে মজে ছিল অনুসূয়া। রাত বাড়ে, খাওয়ার তোড়জোড় শুরূ হয়। হঠাৎ বিশ্বজিতের বেসামাল কন্ঠস্বর কানে আসে অনুসূয়ার।
বিশ্বজিৎ জড়ানো স্বরে বলে চলে - লেডিস এ্যান্ড জেন্টেলম্যান, আজ আমাদের পার্টিতে বিশিষ্ট একজন উপস্থিত আছেন। এক বিশিষ্ট মহিলা কবি। এক অখ্যাতনামা কবি। যার কবিতা একমাত্র তার ব্লগেই থাকে । যদিও তার ব্লগের নাম ইচ্ছে ডানা তবুও তার কবিতারা উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও প্রকাশ পায় না। জানেন তিনি কে ? সবাই বিশ্বজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুসূয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। বিশ্বজিৎ বলে চলে - উনি আর কেউ নন, উনি হলেন আমার সহধর্মিনি, আমার অর্ধাঙ্গিনী, মাই বেটার হাফ কবি অনুসূয়া। ওর কবিতা উড়তে পারে না, তবে উনি ইচ্ছে ডানায় ভর করে উড়তে চান। অনুসূয়ার দিকে টলমল পায়ে  এগিয়ে আসে বিশ্বজিৎ। তার গাল ধরে নেড়ে দিয়ে বলে - ডার্লিং একটা পদ্য বলতো আমরা সবাই শুনি হা হা হা।  সেই মুহুর্তে অনুসূয়া পার্টি ছেড়ে বেড়িয়ে চলে এসেছিল। বিশ্বজিতের জন্য অপেক্ষা করে নি। একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসে। এখনও অনুসূয়া উত্তর খুঁজে যায় কেন বিশ্বজিৎ এভাবে অপমান করল। ব্লগের পাতায় ফুটে ওঠে কয়েকটি লাইন -
দ্রৌপদী আজও উলঙ্গ হয়,
বস্ত্রহরণ!  সে তো রূপক মাত্র।
দুঃশাসন! রূপকের সাজে
যুধিষ্ঠিরের বিবেক।
শব্দ শায়কে নগ্ন নারী
অথবা মত্ত পুঙ্গব স্পর্শে।
সখা আজ নিরুদ্দেশে,
শুধু ঘুণ পোকাদের বাস।
অপরূপার চোখে কাপড়,
জং ধরেছে নিক্তিতে।
টুং টাং করে মোবাইল জানান দিল বার্তা এসেছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অনুসূয়া দেখল ছোট্ট একটা ম্যাসেজ - " ইচ্ছে ডানার ইচ্ছে উড়ান বন্ধ করো না - অঞ্জু দি "।

আজ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অফিস থেকে বেড়িয়েছিল দীপাঞ্জন। দুপুর থেকেই মেঘলা আকাশ আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ করছিল দীপাঞ্জন। তার প্রিয় নীল খাতাটা খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করছিল তার। বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে সোজা গিয়ে বসল তার টেবিলে, টেনে নিল নীল খাতাটা। অন্যদিন বাড়ি ফিরে ছেলের সাথে সময় কাটায়, দিশার সাথে  গল্প করে কিন্তু আজ কোন দিকে খেয়াল নেই তার। দিশা রান্নাঘর থেকে কিছু একটা বলল হয়তো কিন্তু দীপের কান পর্যন্ত পৌঁছাল না সে কথা। রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এই ঘরে আসতেই দিশার চোখ পড়ল দীপের উপর। হাতে নীল খাতাটা দেখেই জ্বলে উঠল দিশা।
- এসেই শুরু করে দিয়েছ ?
- না, একটা ভাবনা মাথায় এসেছে বুঝলে, সেটাই একটু লিখে রাখছি।
- দিনরাত তো শুধু ওইসব নিয়েই পড়ে আছো। কি লাভ এইসব ছাইপাঁশ লিখে।
- তুমি বুঝতে পারছ না দিশা।
- চুপ কর ! তোমার ওই বস্তা পচা যুক্তি আমাকে বোঝাতে এসো না।
- আজ তোমার কি হল দিশা !
- কি হবে ?  হওয়ার কি আর বাকী রেখেছ ? না আছে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, না আছে সিনেমা দেখতে যাওয়া। তোমার যত আবেগ ওই লেখা নিয়ে। কি লাভ হয় বলতে পারো !
- মানে কি বলতে চাইছো তুমি ?
- মানে আর কি ! তোমার এই লেখা কোন কাজে আসে বলতে পারো!  অফিসে যা মাইনে পাও তাতে সংসার খরচ কুলায় না। কত লোক লিখেই তো কত রোজগার করে। আর তুমি নাকি মনের ভালোলাগায় লেখো ! কি দরকার এই লেখার ! শুধু শুধু পেনের কালি আর কাগজ খরচা করো।
- কি বলছ তুমি দিশা !
- ঠিকই বলছি। যেদিন লিখে দুটো পয়সা ঘরে আনতে পারবে সেদিন বুঝবো তোমার লেখার দম।
- না বিকোলে সে লেখা লেখা নয় ?
- না নয়। কোনদিন কাগজের পাতায় ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখেছ ? কেউ কোনদিন তোমার লেখা ছেপেছে?  আজকেরদিনে তোমার লেখা অচল দীপ। তার চেয়ে লেখা ছেড়ে বাড়তি কোন কাজ করার চেষ্টা করো যাতে দুপয়সা বাড়তি রোজগার করা যায়।
- ঠিকই বলেছ দিশা, আমার এই লেখার সত্যি কোন দাম নেই। হয়তো আমি লিখতেই জানি না। মনের কথা পড়ার লোকতো কেউ নেই দিশা। তুমি ঠিকই বলেছো আজকেরদিনে আমি আর আমার লেখা দুটোই অচল।
নীল খাতাটার উপর পরম মমতায় একবার হাত বোলায় দীপ তারপর খাতাটা সরিয়ে রাখে।

রাত গভীর হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দীপ ভাবে সত্যি এই লেখা থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই আমার। দেওয়ারও নেই আর কিছু। দিশার মধ্যে যে না পাওয়ার যন্ত্রণা আছে তা বোঝে দীপ। তাকে দিতে না পারার যন্ত্রণা দীপের মন অবশ করে দেয়। একটা ঘোরের মধ্যে উঠে বসে দীপ। ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। নীল খাতাটা টেনে নেয় সে। আজ এই শেষ লেখাটা লিখে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেবে এই নীল খাতা। কলমের আঁচর পরে সাদা পাতায়।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় দিশার । পাশে দীপের জায়গাটা খালি। ধড়মড় করে উঠে বসে দিশা। দেখে জানালায় আবছা ভোরের আলো। দীপ টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। কাছে গিয়ে দেখে তখনও দীপের হাতে কলম ধরা আছে। চোখের কোল বেয়ে সরু জলের ধারা শুকিয়ে এসেছে। সামনে খোলা নীল খাতা। আলতো করে খাতাটা তুলে নিয়ে পড়তে থাকে দিশা -
স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন দেখি,
স্বপ্নের রঙ নীল।
রঙধনুকের রঙ দিয়ে যায়
স্বপ্নে শঙ্খ চিল।
স্বপ্ন দেখি জীবন সুখের,
স্বপ্ন ভালোবাসার,
স্বপ্ন দেখি জীবন নদে
প্রেমের ভেলা ভাসার।
স্বপ্ন ছিল দু-হাত ভরে
সাজিয়ে দেব তোমায়,
স্বপ্ন ছিল প্রেমের সুরে
ভাসব দুজনায়।
স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন দেখি
স্বপ্ন সাদা কালো,
আঁধার ঘরে প্রদীপ জ্বালি
অধরা চাঁদের আলো।
স্বপ্নের মাঝে স্বপ্ন ভঙ্গ
স্বপ্ন সুখের ইতি,
স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে
পঙ্গু প্রজাপতি।

নিজের অজান্তে চোখটা জলে ভরে ওঠে দিশার। ভোরের আকাশে সূর্যের আভাস দেখা যায়। নীল খাতাটা বুকে আঁকড়ে ধরে দিশা। না, কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে না সে, কিছুতেই না।

********************* সমাপ্ত *********************

বিঃদ্রঃ -  হয়তো কল্পনা, হয়তো অবাস্তব,
             হয়তো কখনও বাস্তব।
            কেউ হয়তো এমনই হয়,
            কেউ বা নয়।।

মন্তব্যসমূহ

  1. অন্য বিষয়। উত্তোরণ লেখায়। এটা অনেকদিন পর এলো। এমন লেখায় অপেক্ষা সাজে।

    উত্তরমুছুন
  2. এরকমই হয়। এক্কেবারে এরকম। বাস্তব এটাই।।দুর্দান্ত লাগল।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস