বর্ষবরণ

কিছুদিন যাবৎ শরীরটা একটু গোলমাল করছে। রক্তচাপ চিনিচাপ দুটোই উর্দ্ধমুখী। ফল স্বরূপ খাওয়াদাওয়ার প্রতি বাড়ির সবার কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান করছি। বছরের শেষদিন একটু মিষ্টিমুখ করার প্রবল ইচ্ছা মনে জেগে উঠল। কথায় বলে যার শেষ ভাল তার সব ভালো। সেই শেষটুকু ভালো করার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলাম। ছোট থেকেই রসগোল্লার প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ। কিন্তু পরিচিত দোকানগুলিতে গেলেই বিপদ। কখন কার সাথে দেখা হয়ে যাবে আর সংবাদ পৌঁছে যাবে সোজা বাড়ির অন্দর মহলে। তারপর কি হবে তা আর খোলসা করে না বলাই ভালো। তাই খুঁজেপেতে একটা অনামি দোকানে হাজির হলাম। কাঠের বেঞ্চে বসে দুটো বড় সাইজের রসগোল্লা নিয়ে সবে এক কামড় দিয়েছি হঠাৎ পিঠে এক বিরাশিসিক্কার থাপ্পর। ভাবলাম হয়েগেল , আজ বাড়ি ফিরে কপালে দূঃখ আছে। ভয়ে ভয়ে পিছন ঘুরে তাকালাম। কিন্তু আধা অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটিকে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। একটু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। ছায়ামূর্তি বলে উঠল -
- কি করে চিন্তে পারছিস না ?
- না মানে ঠিক ঠাহর করতে পারছিনা।
- তা পারবি কেন ? চুপিচুপি এসে সাঁটাতে বসেগেছিস, এখন আর কাউকে মনে থাকে নাকি।
বলেই লম্বা  হাতে খপ করে একটা রসগোল্লা তুলে সটান মুখে চালান করে দিল। হাতটা আমারই প্যান্টে মুছে বলল -
- বেড়ে বানিয়েছে , নে নে আরও গোটা দশেক বল দিকি। একটাতে ঠিক মন ভরলো না। এখন খাওয়া একটু কমিয়ে দিয়েছি তাই গোটা দশেকই বল। হ্যাঁ করে দেখছিস কি ! আরে বাবা ভজহরি মুখুজ্যেরও তো বয়স হয়েছে নাকি। এখন একটু কম খাওয়াই ভালো।
এতক্ষনে ভালো করে দেখে বুঝলাম আজ আমি টেনিদার খপ্পরে পরেছি।
অগত্যা গোটা বিশেক রসগোল্লা একটা মাটির ভাঁড়ে নিয়ে টেনিদাকে বললাম
 -চল ওপাশে ওই গাছ তলায় গিয়ে বসি।
- কেন গাছ তলায় কেন ! তোর কি মতলব বল দিকি!
- আরে চোটছো কেন ! মতলব টতলব কিছু না। এই অনেকদিন পর তোমার দেখা পেলাম তাই একটু নিরিবিলিতে আড্ডা মারব আর কি।
- হেঁ হেঁ চল চল তাই চল।
আমার হাত থেকে রসগোল্লার ভাঁড়টা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে গাছের তলায় বসে পরলো টেনিদা।
- তা টেনিদা হঠাৎ করে তোমার উদয় ব্যাপারটা কি বলতো।
- ব্যাপার আর কিছু না। এই এদিক ওদিক ঢুঁ মারছিলাম । তা তোকে দেখে ভাবলাম আজ সান্ধ্যকালীন জলখাবারটা তোর ঘাড় ভেঙেই করি।
- তা কালতো পয়লা বৈশাখ। কালকের পরিকল্পনা কি ?
- কিছু না। এখন আর এসব ভালোলাগে না।
- কেন গো ! ভালোলাগেনা কেন ?
- ধুর আগে দোকানে দোকানে গেলে কত আপ্পায়ন করে খাওয়াতো। যে দোকানেই যাস কেউ না বলতনা। ওসব নেমন্তন্ন টেমন্তন্নের বালাই ছিল না। আর এখন বিনা নেমন্তন্নে গেলে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। তার উপর মনে মনে হিসাব কষে যে এ ব্যাটা বছরে কত টাকার মাল কেনে তারপর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে দায় সারে। ছোট খদ্দের হলে প্যাকেটটাও ছোট হয় আর বড় খদ্দের হলো বড় প্যাকেট। ছোঃ ঘেন্না ধরে গেছেরে ঘেন্না ধরে গেছে।
- তা যা বলেছ। তবে বর্ষবরণ বলে কথা । কিছুতো করা উচিত নববর্ষে।
- কি আর বরণ করবি। বরণ করতে করতে তো প্রাণ গেল।
- মানে ! ঠিক বুঝলাম না।
- এই দেখ না প্রতিদিনই তো কিছু না কিছু বরণ করতেই হচ্ছে। নতুন টাকা বরণ করে ঘরে তুল সবাই। সে কত উদ্দীপনা। রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়ে পুরানো টাকাকে বিদায় জানিয়ে নতুন টাকা বরণ করে ঘরে নিয়ে এল সবাই।
- সে তো সরকারি নির্দেশ গো ।
- আরে বকলমে সবইতো সরকারি।
- তা মন্দ বলনি।
এদিকে টেনিদা একটা একটা করে রসগোল্লা সাঁটিয়ে চলেছে। আমি সুযোগ বুঝে একবার হাত বাড়াতে গেলাম । নিমেষে ভাঁড়টা সরিয়ে নিয়ে বলল। তোদের এত নোলা কিসের রে। চিনিচাপে মরছিস তবু কৃচ্ছ সাধন করতে শিখলি না।
- আচ্ছা আচ্ছা যা বলছিলে বলো।
- এই দেখ সেদিন নতুন ভাবে রামনবমী পালন হল। লোকে কত আনন্দ করে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে মিছিল করল। যারা করল না তার বিরোধিতা করে আনন্দ করল। কত লোকে তর্ক বিতর্ক করে আনন্দ করল। আর আমরা ভালো মন্দ দুটোকেই বরণ করে নিলাম ।
- ঠিক বুঝলাম না।
- বুঝে আর কি করবি ! ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে আগে ব্যাঙ্ক সুদের টাকা দিত। এখন উল্টে তোকে টাকা দিতে হবে, নিজের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলবি তাও তোকে টাকা দিতে হবে। কেন দিতে হবে বুঝেছিস কি ? বুঝিস নি। তাই বেশি বুঝতে যাস না। শুধু উৎসব করে যা।
- আমরা সাধরণ লোক আর কি করব বলো।
- কি আর করবি । একদিকে গোমাতা রক্ষক কমিটি তৈরী হবে। লোকে হৈ হৈ করে নাচবে। সেই সুযোগে দেশমাতা ভক্ষক কমিটি ক্ষীর খেয়ে চলে যাবে। আর তোরা খালি হাঁড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করবি।
- বুঝলাম।
- কি বুঝলি ?
- এই যে কাল তোমার বর্ষবরণের কোন প্রোগ্রাম নেই।
- ওরে এই বর্ষবরণ কথাটাই তো ভুল।
- ভুল !
-হ্যাঁ ভুল। বর্ষবরণ নয় ওটা হবে বর্ষহরণ।
- বর্ষহরণ !
- হ্যাঁ, বর্ষহরণ। একটা করে নতুন বছর আসে আর জীবন থেকে একটা  বছর আয়ু কমে যায়। আর আমরা উৎসব করি। যাক তোকে এসব কথা বোঝানো মানে ভষ্মে ঘি ঢালা। তবে যত না বুঝবি তত আনন্দে থাকবি।
এত বকবক করে খাওয়াটাই মাটি করলি।
রসগোল্লার ভাঁড়ের অবশিষ্ট রসটুকু গলাধকরণ করে টেনিদা উঠে দাঁড়াল।
- আজ চলি বুঝলি । মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে। চারিদিকে যা গরম।
আমি ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। শরীরটা আনচান করতে লাগল। তা সে রসগোল্লার শোকে না কি আবহাওয়ার দোষে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙেগেল। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কখন কারেন্ট গেছে কে জানে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সূর্যের ঘুম ভাঙছে। নতুন বছরের নতুন ভোর। আজ নববর্ষ। চোখে তখনও স্বপ্নের রেশ। সত্যি কি আজ বর্ষবরণের উৎসব ! নাকি জীবনের পাতা থেকে আরও একটি বর্ষহরণ !

*********** সমাপ্ত *********
নতুন বছরে সবাই নিজের মতো করে ভালো থাকুন এই কামনাই করি।
সুদীপ্ত চক্র
১লা বৈশাখ ১৪২৪

মন্তব্যসমূহ

  1. বাহ! সত্যি তো তাই নতুন বছর আসার সাথে সাথে আমাদের বয়েস বাড়ে আর পুরোন বছর ইতিহাসের পাতায় চলে যায়।

    উত্তরমুছুন
  2. আমি লেখাটা পড়লাম অনেক দেরি করে। তাড়াহুড়ো করে পড়তে চাইনি। আর সেটা কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা লেখাটা শেষ করে বুঝলাম। ছোটো পরিসরে, রূপক অবলম্বন করে , দৈনন্দিন ছন্দ বজায় রেখে নিজের অবস্থান থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য ফুটিয়ে তোলা বড় শক্ত কাজ। অথচ কত অবলিলায় সেটা করা গেছে। আর বক্তব্য কাচের মত স্বচ্ছ। কোথাও এতটুকু জড়তা নেই। সাব্বাস।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস