ভোরবেলার শিউলি

ভাদ্র আশ্বিন এই দুই মাস শরৎ কাল। শরত্‍কালে বাঙালীর প্রধান উত্‍সব দূর্গাপুজো হয়। এইসময় সবাই আনন্দে মেতে ওঠে ..........
দূর্গাপূজা রচনাটা মুখস্থ করতে করতে সামনের খোলা জানলাটা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায় শিউলি। দূরে নীল আকাশের গায়ে পেঁজা তুলোর মতো টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তাইতো শরত্‍কাল তো চলে এসেছে, মনে মনে ভাবে সে। মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করে শিউলি। কেন যে সবাই বলে দুগ্গা পুজো বাঙালীর সবচেয়ে বড় আনন্দ উত্‍সব ভেবে পায় না সে। আচ্ছা ওরা কি বাঙালী নয় ! দুটি চোখ জলে ভরে আসে শিউলির। মাথায় হঠা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকায়, দেখে মা কখন যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
-
কি রে পড়তে পড়তে হঠা থেমে গেলি কেন ? ওমা চোখে জল কেন মা !
-
আচ্ছা মা আমরা কি বাঙালী নই ?
-
ও মা এ আবার কেমন সৃষ্টি ছাড়া কথা!
-
না মা বইতে লিখেছে বাঙালীর সবচেয়ে আনন্দ উত্‍সব দুগ্গা পুজো।
এবার মা বুঝতে পারে মেয়ের মনের দুঃখ, মেয়ের চোখের জল। মেয়ের মাথায় হাতবুলিয়ে বলে - মন খারাপ করিসনে মা, নে তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে চান খাওয়া করে নে। স্কুল যেতে হবেতো নাকি?

বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মাঝামাঝি এক প্রত্যন্ত গ্রামে শিউলিরা থাকে। বাবা মহাদেব বায়েন। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। গ্রামের গরীব সম্প্রদায়ের মধ্যেই পড়ে তারা। মহাদেব লোকের জমিতে জন খাটে। আসলে এটা কিন্তু ওর পেশা নয়। পেটের দায়ে তাকে এই পেশা বেছে নিতে হয়েছে। আসলে সে জাত বাজনদার। তার বাপ- ঠাকুরদার নাম আশেপাশে গাঁয়ের লোকের মুখেমুখে ছড়িয়ে আছে। মহাদেবের হাতটিও মন্দ নয়। লোকে বলে তার হাতের কাঠি কথা বলে। সে নিজেও জানে তার হাতের কাঠি ঢাকের পিঠে কথা বলে। দুই ছেলে- মেয়ে আর বৌ এই নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। থাকার মধ্যে বাপ-ঠাকুরদার এই ভিটেটুকু ছাড়া ওই তিন কাঠা জমিটুকু, তাও বছরের অর্ধেক সময় অনাবাদী পড়ে থাকে।

এই ভরা ভাদরে মাঠে কাজ করা অসহ্য হয়ে পরে। মহাদেব, মন্ডলদের জমি থেকে উঠে এসে গাছের ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। ট্যাঁক থেকে একটা বিড়ি বেড় করে ধরায়। সুখটান দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের গায়ে সাদা মেঘের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছে। নাঃ পুজো তাহলে এসেই গেল, সময় করে ঢাকটা পেড়ে এবার রোদে সেঁকতে দিতে হবে মনে মনে ভাবে সে। মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়, নিজের মনেই হেসে ওঠে সে। ঢাক রোদে দিলেই সেই ছোট থেকেই মেয়ে রোজ ঢাকের উপর কাঠি দিয়ে মক্শ করতে থাকে, যতদিন ঢাক রোদ খাবে ততদিন মেয়ের মক্শ চলতে থাকবে। 
যদিও কেউ এখনও বায়না দেয়নি কিন্তু দিতে কতক্ষন। নাঃ এবার আর বেশী দূরে বায়না নেবে না। 
মেয়েটা বড় হয় উঠছে, ঘড় ছেড়ে বেশী দূরে যাওয়া এখন আর ঠিক না। বউ একা আর কত দিক সামলায়, মন্ডলদের বাড়ির ধান মুড়ির কাজও তো তাকে দেখতে হয়। এইসব ভাবতে ভাবতে মাঠে নেমে আসে সে। 

মেয়ের চোখে জল দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায় মায়ের। উনুনের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায় সে। কত আর বয়স শিউলি, এইতো পুজোতে এগারো পেরোবে। 
মেয়েটা বড্ড সরল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মেয়ে মায়ের নাম জানতো না, ইস্কুলের কি একটা কাগজে মায়ের নাম লিখতে হবে তাই বাড়ি এসে বলে মা তোমার কোন নাম নেই ? শুনে শিউলির বাপের কি হাসি, হাসতে হাসতে বলল - আছে রে আছে তোর মায়ের নাম একটা আছে, তোর বাপ মহাদেব আর তোর মা উমা হা হা হা । 
শিউলির জন্মের আগের বছর ওর বাপ বিষ্ণুপুরে বায়না নিয়ে গিয়েছিল। বেশ বড় পুজো হয় ওখানে। হারাণ খুড়োও গিয়েছিল বায়না নিয়ে। উমাদের পাশের ঘরই হারাণ খুড়োদের। বয়স হয়েছে খুড়োর তবুও ওই নেশার টানে বায়না নেওয়া। মহাদেবের বাজনা শুনে তাক লেগে যায় হারাণ খুড়োর। বাড়ি ফেরার সময় খুড়ো জোর করে ধরে আনে নিজের গাঁয়ে। উমার বাপের সাথে মহাদেবকে আলাপ করিয়ে দেয় খুড়ো। একথা সেকথার পর খুড়োই প্রথম কথাটা পাড়ে - বুঝতেইতো পারছ উমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, তা তুমি যদি মেয়েটিকে উদ্ধার কর তাহলে মেয়েটার একটা গতি হয়। মহাদেব না করতে পারে নি। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই বিয়ে করে নিয়ে আসে উমাকে। নিজের বলতে মহাদেবের তেমন কেউ ছিল না। বাপ-মা অনেক কাল আগেই গত হয়েছে। এ বাড়িতে পা দিয়েই সংসার সামলাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে উমা। সংসারে মানুষতো মাত্র দুজন, অসুবিধা হয়না উমার। পরের বছর ষষ্টীর দিনে উমার কোল জুড়ে আসে ছোট্ট মেয়েটি, বাপ আদর করে নাম রাখল শিউলি 
ছেলেটা শিউলির থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। দেখতে দেখতে সব কত বড় হয়েগেল। 
-
মা খেতে দাও, ইস্কুলের দেরী হয়ে যাবে। 
মেয়ের কথায় চমক ভাঙে উমার। 
-
হ্যাঁ এই যে দিই মা, তুই ভাইকে ডাক আমি ভাত বাড়ছি। 

শিউলির মনটা আজ ভালো নেই। ইস্কুলে এসেও পড়ায় মন বসছে না তার, শুধু তার চোখ ক্লাসের জানলা দিয়ে ওই আকাশের পানে চলে যাচ্ছে। 
ইস্কুল ছুটির পর দুই ভাইবোন হাত ধরে বাড়ির দিকে পা চালায়। 
রাস্তার দুপাশে ইতিউতি কাশফুলের ঝাড় দেখা যায়। 
-
দিদি আমাকে একটা কাশফুল দিবি ? 
ভাইয়ের আবদারে কাশফুল তুলে এনে দেয় শিউলি 
-
হ্যাঁ রে ভাই তুই নাকি এবার পুজোয় বাবার সাথে যাবি ? 
-
হ্যাঁ রে দিদি বাবা বলেছে বাবার সাথে গেলে ওই পুজোর বাবুরা নতুন প্যান্ট আর এটা গেঞ্জী দেবে বলছে। 
-
তাই ! 
-
হ্যাঁ বাবা তো তাই বলল। আচ্ছা দিদি পুজোর সময় আমরা নতুন জামা পরিনা কেন রে ? 
-
আমাদের পরতে নেই তাই পড়িনা। 
-
আচ্ছা দিদি আমায় তো নতুন প্যান্ট আর গেঞ্জী দেবে কিন্তু তুই কি পরবি ? 
-
আমি ! আমি আবার কি পরবো ! মেলা বকবক করিস না তো চল তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। 
-
দিদি আমি ওই বাবুদের বলব আমাকে শুধু প্যান্ট দিলেই হবে, আমার গেঞ্জী চাই না। তার চেয়ে তোমরা দিদর জন্য একটা নতুন জামা দাও। 
-
দূর পাগল চল তাড়াতাড়ি পা চালা। 

গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে ঠিকই কিন্তু আলোর তেজ খুব কম। আলোগুলো টিমটিম করে জ্বলে। শিউলিদের অত পয়সা দিয়ে আলো জ্বালাবার সামর্থ নেই। অবশ্য শুধু ওরা একা নয় এরকম বেশ কয়েক ঘরই আছে। এই গ্রামেরই কিছু ছেলেরা মিলে যাদের অবস্থা তেমন নয় তাদের ঘরে বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তার দিয়ে আলোটুকু জ্বলার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। শিউলি জানে এটা একরকম চুরি করে আলো জ্বালানো। কিন্তু উপায় কিছু নেই। রেশনে কেরোসিন তেলও দেয়না ঠিক মতো যে কুপিটাও জ্বলবে। 
সেই মৃদু আলোতেই দুই ভাইবোন দুলে দুলে পড়া মুখস্ত করছিল। বাবা এক কোণে বসে মুড়ি খেতে খেতে বলল - বুঝলি আজ দুপুরে একটা পুজোর বায়না পেলাম। এবার আর বেশী দূরে যাব না। শিউলি মুখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। বুকের ভিতর কষ্টটা আবার চাগার দিয়ে উঠল। 
ভাইকে দেখল বাবার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ভাই বলল 
-
বাবা আমিও যাব তো ? 
-
হ্যাঁ রে সেইরকম কথাই হয়েছে। 
-
কবে যাব বাবা ? 
-
ওরা বলেছে ষষ্টীর দিন দুপুরের মধ্যে গেলেই হবে। 
-
এখান থেকে অনেক দূর, বাবা ! 
-
না রে এবার কাছে পিঠেই নিলাম বুঝলি। এখান থেকে এই ঘন্টা দুয়েক লাগবে পৌঁছাতে। 
-
সেই ভালো বাবা, পুজো শেষ হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে পারব। 
শিউলির কানে আর কোন কথা ঢুকছিল না। সে শুধু ভাবছিল পুজোর দিনগুলোর কথা। প্রত্যেক বছরই বাবা পুজোর সময় বায়না নিয়ে চলে যায় আসে সেই পুজো পার করে। সাথে অবশ্য এখানের আরো দু-একজনও যায়। তারাও এই পেশায় আছে। কখনও একসাথে বায়না হয় কখনও আলাদা। ভালোলাগেনা শিউলির। পুজোর দিনগুলো বড় একা লাগে। তবুও ভাই সাথে থাকত। ওদের গ্রামেও একটা পুজো হয় যদিও অত জৌলুস নেই তবুও ওখানে গ্রামের সবাই হাজির হয় নতুন জামা-কাপড় পরে। শিউলির যেতে ভালোলাগত না। নতুন জামা কোথায় পাবে ! তেমন কোন ভালো জামাও নেই যে পরে সেখানে যাবে। ভাইয়ের ওসব বালাই নেই। পুজোর দিনগুলো ওকে ঘরে পাওয়াই দায়। গ্রামের ছেলেদের সাথে মেতে থাকে খেলায়। কেউ কিছু বললে ও অত মনে নেয় না। শিউলিও যেতো আগে কিন্তু সেবছর গ্রামের কিছু বাবুদের মেয়ে ওর পরণের পুরানো জামা নিয়ে কটু কথা বলতে সে মায়ের কাছে এসে বলেছিল মা আমি আর পুজো দেখতে যাবোনা। ওরা আমাকে নিয়ে মজা করে।   আচ্ছা মা আমাদের কেন নতুন জামা হয় না ? 
মা বলেছিল মন খারাপ করিস না মা, পুজোতে আমাদের নতুন জামা-কাপড় পরতে নেই। 
এখন শিউলি বোঝে সবকিছু। সে বোঝে নতুন জামা দেওয়ার সামর্থ বাবার নেই। পুজোর বায়নার শেষে ওখানকার লোকেরা দয়া করে কিছু জামা-কাপড় দিলে বাবা নিয়ে আসে। তার মধ্যে যে ভালো কিছু থাকে না তা নয়, ওটাই তখন ওদের কাছে নতুন। আসলে বাবা কাছে থাকলে শিউলির সবকিছুই ভালো লাগে। যারা পুজোয় সময় বায়না নিয়ে দূরে চলে যায়, তারা ফিরে এলেই সব ঘরে যেন উত্‍সব লেগে যায়। ওদের বরঞ্চ লক্ষী পুজোয় আনন্দ হয় বেশী। বাবার আনা জামা পরে ওরা বাড়ি বাড়ি লক্ষীপুজোর দেখতে যা। ঘরে মাও অনেক রকম খাবার বানায়। খুব মজা হয়। কিন্তু এই দুগ্গা পুজো ওর একদম ভালো লাগেনা। আসলে বাবা বাড়ির থেকে দূরে থাকে যে, বড্ড মন খারাপ করে। এবার আবার ভাইটাও থাকবে না, এই কদিন একা একা কি করবে ও! বুকটা খালি খালি লাগে। 
-
চলে আয় খেতে দিয়েছি। 
মায়ের ডাকে বই গুছিয়ে উঠে পরে শিউলি। বাবার দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায় সে। 

মহাদেব মেয়ের দিকে অনেক্ষন থেকেই তাকিয়ে ছিল। মেয়ে চলে যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। সে বুঝতে পারে শিউলির মনের কথা কিন্তু কি করবে উপায়তো কিছু নেই। তার ও যে মেয়েটাকে চোখের আড়াল করতে কষ্ট হয়। যখন শ্বশুরবাড়ী যাবে তখন কার কথা আলাদা। কিন্তু এই ছোট বয়সে পুজোর দিনে মেয়েকে ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হয়। মেয়েটা জন্মানোর সময়ও সে দূরে ছিল। সেবার ফিরতে দুদিন দেরীও হয়েছিল। গাঁয়ে ঢোকার মুখে সে সুখবরটা পায়। আনন্দে ছুটতে ছুটতে ঘরে এসেছিল সে। উমার কোলে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ের মুখটা দেখে সে এতটা পথের ক্লান্তি ভুলেগিয়েছিল। 
মহাদেব বোঝে এবার আবার ছেলেটাকে নিয়ে যাবে তাতে শিউলির আরও কষ্ট হবে। সে চায় না ছেলেটা তার মতো এই কাজ করুক কিন্তু তার যা অবস্থা তাতে ছেলেটাকে কতটা মানুষ করতে পারবে তা নিয়ে মনে ধন্দ আছে। তাই সে ছেলেকে এই কাজটাও শিখিয়ে রাখতে চায়। যদিও ছেলের তেমন আগ্রহ নেই, তুলনায় মেয়ে কিন্তু বেশ বাজায়। তবুও ভাবে ছেলেটাকে শিখিয়ে তো রাখি, ছেলে বড় হয়ে যা পারে করবে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় মহাদেব, মনটা তারও খারাপ হয়ে যায়। 

আজ একটু গরম বেশী। ভাদরের পচা গরম। শিউলির বাবা বাইরেই শুয়েছিল, ঘরে মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে উমা। কিন্তু ঘুম আসছিল না। সেই বিয়ের পর ভরা মাসে উমাকে রেখে যখন স্বামী বায়না নিয়ে গেল তখন তার যতটা কষ্ট হয়েছিল, তার থেকেও অভিমান হয়েছিল বেশী কিন্তু কি করবে এই ঢাকের দৌলতে কিছু মোটা টাকা ঘরে আসে তা সে ভালোভাবেই বুঝতো। শিউলি আর ছেলে কোলে আসার পর তার আর অতটা খারাপ লাগত না। তবুও আনন্দের দিনে সব মেয়েমানুষই নিজের স্বামীর সোহাগ চায়। মন বড় অবুঝ, বুঝেও বুঝতে চায় না। 
ছেলেটা ঘুমিয়ে পরেছে। সারাদিন যা দস্যিপনা করে, রাতে আর কোন হুঁস থাকেনা। উমা বুঝতে পারল মেয়ে এখনও ঘুমায়নি। সে পাশ ফিরে মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল কিরে ঘুম আসছে না ? ঘুমিয়ে পর মা, মন খারাপ করিস না। কি করবি বল! আমাদের মতো ঘরে এটাতো মেনে নিতেই হবে তাই না, আর ঢাক ছাড়া কি পুজো হয় ? মা দুগ্গাকে প্রনাম জানাবার এটাও তো একটা পথ। বামুন ঠাকুর মন্ত্র দিয়ে ফুল দিয়ে পুজো করে আর তোর বাপ ঢাক বাজিয়ে মায়ের পুজো করে। আমরা না হয় লক্ষীপুজোতেই আনন্দ করব। শিউলি মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গোঁজে।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল শিউলিদের জীবন গত পুজোয় শিউলি ১৮ বছর পার করেছে পড়াশোনাতে সে মন্দ নয় বারো ক্লাসের পরীক্ষাও পাশ করে গেছে ভেবেছিল আর হয়তো পড়াশোনা হবে না, কিন্তু মন্ডল গিন্নী বাবুকে বলে কলেজে ভর্তি করার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন ভাইটার পড়াশোনায় তেমন মন নেই, আর দুবছর পর যে মাধ্যমিক দেবে সে বিষয়ে কোন হুঁস নেই 

বাবা এবছরও বায়না নিয়েছে শিউলি বোঝে বাবার বয়স হচ্ছে কিন্তু উপায় কিছু নেই এই বায়না থেকে যেটুকু পয়সা আসে তাতে সংসারের অনেক প্রয়োজন মেটে অবশ্য মন্ডল গিন্নী অনেক সাহায় করেন শিউলি ঠিক করেছে কলেজটা পাশ করে সে কোন একটা কাজ খুঁজে নেবে, বাবাকে এবার বিশ্রাম দিতে হবে 

এবছর ভাদরের শুরুতেই লোক এসে বায়না দিয়েগেছে, আগের মতো কেউ আর ষাকষি করে না বায়না বাবদ বেশ কিছু টাকাও দিয়ে যায় তার উপর ওর বাপের নাম আছে ঢাক বাজাবার জন্য, তাই আর কেউ দড়াদড়ি করে না 
এবছর বৃষ্টির তেমন দেখা নেই যাওবা দু-এক পশলা হচ্ছে, তাতে মাটিও ভালো করে ভিজছে না বর্ষাতেও তেমন বৃষ্টি হয়নি 
রাতে খাওয়ার পাট অনেকক্ষন চুকে গেছে এই গুমোট গরম অসহ্য লাগছে মহাদেব আজ ঘরের বাইরে শুয়েছে একটা বিড়ি ধরিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল নাঃ এবার কলেজ পাশ করলেই একটা ভালো ছেলে দেখে মেয়ের বিয়েটা দিতে হবে মেয়ে আমার দেখতে মন্দ নয়, একটা ভালো ছেলে ঠিক পেয়ে যাবে সে এবার না হয় পুজোতে বায়না নিয়ে যেখানে যাচ্ছে সেখানে একটু খোঁজ খবর করবে হাতের বিড়িটা শেষ হয়ে এসেছিল , বিড়িটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলো সে ঘুম প্রায় এসেই গিয়েছিল হঠাৎ পায়ে একটা যন্ত্রনা অনুভব করল মহাদেব, তাড়াতাড়ি উঠে বসে দেশলাইটা জ্বালতেই চোখে পড়ল একটা দড়ি যেন এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে মহাদেব চিৎকার করে উঠল শি........লি....... 

শিউলি চোখটা প্রায় লেগে এসেছিল, হঠা বাবার আর্ত চিৎকার শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে দরজা খুলে বাইরে আসতেই চোখে পড়ে বাবা মাটিতে ছটফট করছে দৌড়ে বাবার কাছে এসে মাথাটা কোলে তুলে নেয় 
-
বাবা বাবা কি হয়েছে তোমার ! এমন করছ কেন ? 
-
মা আমাকে সাপে কেটেছে রে 
-
কিছু হবে না বাবা কিছু হবে না, ভাই একটা দড়ি নিয়ে আয় 
শিউলি তাড়াতাড়ি তার বাপের পায়ে বাঁধন দেয় 
আশেপাশে তখন গ্রামের লোকজন জমা হয়ে গেছে কেউ বলে ওঝা ডাকো, কেউ বলে না না গুনিন কে খবর দাও, চাল পোড়া দিলে, বাটি বসালে সব বিষ নেমে যাবে 
শিউলি কিন্তু এসব কানে নেয় না, সে বলে - না আমি বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো মন্ডল গিন্নী শিউলিকে বলেন তাই কর মা তাই কর 
গ্রামের ছেলেরা একটা মটর ভ্যান নিয়ে আসে শিউলি বাবাকে নিয়ে চেপে বসে তাতে সাথে ভাই আর গ্রামের আরো কয়েকটি ছেলে 
শিউলি মা মন্ডল গিন্নীকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে 

আজ প্রায় পনেরো দিন পর মহাদেব বাড়ি এলো এতদিন যমে মানুষে টানাটানি চলেছে প্রথম কয়েকদিন জ্ঞা ছিলনা তার তারপর যখন জ্ঞা এলো তখন দেখলো সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তখন প্রায় মাঝরাত, নার্স দিদিমণিদের সে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার বাড়ির কেউ নেই ! দিদিমণিরা বলল নেই কি গো তোমার মেয়ে সেইদিন থেকে ঠায় বসে আছে হাসপাতালে, দাঁড়াও তাকে খবর দিচ্ছি 
খবর পেয়ে শিউলি দৌড়ে আসে এতদিন তার চোখে কেউ জল দেখেনি, কিন্তু এখন বাবাকে দেখে শিউলি চোখ বেয়ে জল নেমে আসে মহাদেব হাত বাড়িয়ে দেয়, শিউলি হাতটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে মহাদেব ছেলের কথা শুধায়, শিউলি বলে ভাই বাড়ি গেছে কাল সকালে চলে আসবে, তুমি ঘুমাও বাবা নার্সদিদিমণি মেয়েকে নিয়ে চলে যায়, বলে এখানে এত রাতে মেয়েরা থাকতে পারবে না, সকাল হলে যত খুশি মেয়ের সাথে কথা বলো
 
মহাদেব ভাবেনি যে সে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসবে ফিরে সে এসেছে কিন্তু তার শরীরে নাকি বিষ ছড়িয়ে পরেছিল, তাই শরীরের নিচের দিকটা অসাড় হয়েগেছে কবে যে ঠিক হবে ডাক্তারবাবু কিছু বলতে পারেনি 
মহাদেবের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে মায়া ভরা দুটি হাত চোখের জল মুছিয়ে দেয় 
-
বাবা তুমি কাঁদছ কেন ? আমিতো আছি দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে 
মহাদেব চোখ মেলে শিউলিকে দেখে, পায়ের কাছে দেখে উমা বসে আছে 

পুজোর আর বেশীদিন বাকী নেই, মহালয়া আসতে চললো মহাদেব চিন্তায় পড়েগেল এবার পুজোয় বায়না যে সে নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু সে যাবে কি করে ! সে তো এখন পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছে , কি হবে এখন ! বায়না বাবদ যে টাকা পেয়েছিল তাও তো খরচ হয়েগেছে, এই সব ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়ে সে 
এমন সময় কে যেন বাইরে থেকে ডাকে - মহাদেব বাড়ি আছো ? 
ডাক শুনে সে বাইরের দিকে তাকায়, দেখে যিনি এবার পুজোর বায়না দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি এসেছেন 
মহাদেব বলে - আসুন বাবু আসুন 
-
মহাদেব তোমার খবর পেয়েই আমি এলাম 
-
হ্যাঁ বাবু অদৃষ্টের দোষ হঠা কি যে হয়েগেল ! 
-
চিন্তা করোনা মহাদেব, ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে তুমি 
-
সেই আশর্বাদই করেন বাবু, না হলে আমার পরিবারটাই ভেসে যাবে 
-
তা তো বুঝলাম কিন্তু তোমার শরীরের যা অবস্থা তাতে তো তুমি এবার যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না 
-
কি করে যাব বাবু ! পা দুটি যে অসার হয়ে গেছে 
-
তুমি বরং বায়নার টাকাটা ফেরত দাও আমি অন্য কাউকে ব্যাবস্থা করি 
-
টাকা কি করে দেব বাবু ! টাকাতো খরচ হয়ে গেছে 
-
তা বললে কি করে হবে ! বুঝতেইতো পারছ, গ্রামের ব্যাপার 
-
কিন্তু বাবু আমার অবস্থাতো দেখছেন, হাসপাতালেও অনেক খরচা হয়েগেছে 
-
দেখ বাপু ওসব বলে কোন লাভ নেই, টাকা ফেরত দাও আমি চলে যাচ্ছি 
এমন সময় শিউলি ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসেবলে 
-
দেখুন টাকাটা সত্যি খরচ হয়েগেছে আর টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা এখন আমাদের নেই, তবে একটা কথা আমি আপনাকে দিতে পারি, আপনি নিশ্চিন্তে গ্রামে ফিরে যান আপনাদের গ্রামে পুজোর সময় ঠিক ঢাক বাজবে 
-
বললেই হলো ঢাক বাজবে ! কি করে বাজবে শুনি ! মহাদেব তো বিছানা নিয়েছে 
-
বললামতো বাজবে
-ঠিক আছে, আমি এখন যাচ্ছি কিন্তু ষষ্টীর সন্ধ্যেতে গ্রামে যেন ঢাকের আওয়াজ শোনা যায়।
 - বললামতো ঢাক বাজবে, আপনি এখন আসুন
শিউলি চোখের ভাষা দেখে লোকটা আর দাঁড়াতে সাহস পেল না, চুপচাপ চলে গেল 

মহাদেব বললো - মা তুই একি বললি ! কি করে ঢাক বাজবে ! কে বাজাব ! 
-
বাবা তুমি চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে 

পুজোর আর দেরী নেই আর মাত্র দুদিন কিন্তু কি করে কি হবে ! শিউলি বলল সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু কি করে হবে ! যদি কাল রওনা না দেওয়া যায় তাহলে সময় মতো ঢাকে কাঠি পরবে না মা দুগ্গা একি করলে তুমি! 
অস্থির হয়ে ওঠে সে এই নিঝুম রাতেও ঘুম আসে না তার চোখে 

শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল মহাদেব হঠা ঘুমটা ভেঙে যায় বাইরে ভোরের আলো সবে দেখা দিয়েছে ঘরের দরজার দিকে চোখ পরে তার, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে সদ্য স্নান সেরে লালপেড়ে সাদা শাড়ী পরে যেন মা দুগ্গা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে
অস্ফুটে বলে ওঠে সে - শিউলি ! 
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে শিউলি চোখে মুখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা এক দৃঢ় প্রত্যয় এগিয়ে এসে প্রণাম করে মহাদেবকে
বলে - বাবা তুমি ভেবো না , বাবা-মায়ের অসম্পূর্ন কাজের দায়িত্ব তো সন্তানের তুমি শুধু আশীর্বাদ করো আমি যেন সফল হই 
মহাদেব মেয়ের মাথায় হাত রাখে, উমা এসে পাশে দাঁড়ায় স্বামীর কাঁধটা শক্ত করে ধরে 
শিউলী এগিয়ে গিয়ে ঢাকটা কাঁধে তুলে নেয় ধীরে ধীরে ভাইয়ের হাত ধরে গ্রামের রাস্তা ধরে 
আজ মহাষষ্ঠী,উমার কোলে শিউলি নব জন্ম হলো 
ভোরের আকাশে তখন শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে
মা দুগ্গা আসছেন, আজ যে মায়ের বোধন ! 

মন্তব্যসমূহ

  1. অপূর্ব লেখা।।মন ভরে গেল সক্কাল বেলা। আহা, এরকম গল্প আজকাল খুব কমে গেছে রে। সাব্বাস। দারুন লিখেছিস ভাই। আমি ৩ বার পড়লাম পরপর

    উত্তরমুছুন
  2. আমি লক্ষ্য করেছি তোমার গল্পের প্লটগুলো বেশ অন্যরকম হয়। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। গল্পে মনুষ্যত্ব, নারীশক্তি, দৃঢ় প্রত্যয় - এসবগূলো এত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে যে চোখটা বোধহয় অজান্তেই একটু আদ্র হয়ে ওঠে। গ্রামের ছবি, শরতের ছবি, ঢাকিদের ছবি - এসবই খুব সুন্দরভাবে মনে দাগ টেনে গেল, বলতে পারো অনেকদিন পর আবার সেই সুন্দর শরৎ ফিরে পেলাম।

    আমি বলব, এটা একটা লড়াইয়ের গল্প, হার না মানা এক জীবনের গল্প। একটা কথা মাথায় এলো - মেয়েটির নাম যফি "উমা" হত, তাহলে এই গল্পটাকে একটা রূপক হিসেবেও দেখা যেত, মেয়েটি আক্ষরিক অর্থেই দশভুজা।

    উত্তরমুছুন
  3. আপনার লেখার মধে্য একটা সহজ সরল ধারা আছে, যেটা খুবই আকর্ষনীয় । পূজোর আগেই পূজোর গন্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, আপনাকে।

    উত্তরমুছুন
  4. অসাধারণ। তুখোড়। উমদা। ধুর, কোন শব্দ টাই ঠিক হচ্ছ না। আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না কতটা আমার ভালো লেগেছে। তাই চুপ করেই থাকি। আরেকবার পড়ি বরঞ্চ।

    উত্তরমুছুন
  5. এইরকম পাঠক/পাঠিকা পেয়ে আমি ধন্য যাঁরা ভালো ছাড়া খারাপ কোনদিন বলতেই পারেন না। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ আর শারদীয়ার আগাম শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস