অপরাজিতা

- এত ছটপট করিস কেন অপা ? একটু ধৈর্য্য ধরে বসতে পারিসনা ? সবসময় এত অধৈর্য হলে চলে ! 
-
কি করব মা, অঙ্কটা যে কিছুতেই মেলাতে পারছি না 
-
ঠিক মিলবে চেষ্টা কর ঠিক হবে 
-
কি করে হবে ? দিদিমনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই তো করলাম, তবু হচ্ছে না 
-
অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখ 
-
অন্যভাবে মানে ? 
-
অন্যভাবে মানে অন্যভাবে আরে ইংরাজীতে ওই এক্সপেরিমেন্ট না কি যেন বলে তাই আর কি 
-
অঙ্কে আবার এক্সপেরিমেন্ট হয় না কি ? 
-
হয় রে হয়, জীবনের সবকিছুতেই হয় কখনও সফল হয় কখনও হয় না তা বলে ভেঙে পড়লে চলবে না, সব সময় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে 
অপা মায়ের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মা এমন ভাবে বলে যে মনেহয় সব বুঝে ফেললাম, কিন্তু পরক্ষনেই মনেহয় কে জানে ঠিক বুঝলাম তো ! 
মা একদিন কথায় কথায় বলেছিল তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার জন্য মায়ের লেখাপড়ার আশা পূর্ণ হয় নি তাহলে মা এত শক্ত শক্ত কথা জানলো কি করে ! কে জানে, মায়েরা হয়তো সব জানে 

অপা পড়াশোনায় খারাপ না ক্লাসে ফার্স্ট হতে না পারুক, দশের মধ্যে অপরাজিতা রায় এর নাম অবশ্যই থাকবে 
এবার সে ক্লাস নাইনে উঠল কলকাতার এক শহরতলি এলাকায় তাদের বাড়ী তাদের স্কুল বেশী দূরে নয় কাছাকাছির মধ্যে এর থেকে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর নেই পড়াশোনার ব্যাপারে সে খুব সিরিয়াস বাবা বলতো অপা মন দিয়ে পড় মা, ফাঁকি দিস না, ফাঁকি দিলে নিজেই ফাঁকে পড়বি অপা বাবার কথাটা এখনও মেনে চলার চেষ্টা করে শুধু পড়াশোনা নয়, সে যা কিছু করে মন দিয় করার চেষ্টা করে 
সেদিন অফিসে গিয়ে বাবার কি যে হল! হঠা করে অফিসের মধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ে যায় বাবা, না আর উঠতে পারে নি চিরদিনের জন্য ঘুমের দেশে চলে গেল বাবা তখন অপার কত আর বয়স ! সে তখন ক্লাস থ্রি তে পড়ে 
-
কি রে অপা কি ভাবছিস ? 
মায়ে ডাকে চমক ভাঙে 
-
কি মা ? 
-
অঙ্কটা মিলল ? 
-
না, চেষ্টা করছি তো 
-
বসে বসে কি ভাবছিলি ? 
-
ওই যে তুমি বললে না এক্সপেরিমেন্ট , সেটাই ভাবছিলাম 
-
ভেবে কি পেলি ? 
-
তুমি ঠিকই বলেছ, সবকিছুই একটু অন্য রকম ভাবে করে দেখা উচিত 
মা অপার মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো 
অপা নিজের মনের মধ্যে আর একটা শব্দ গেঁথে নিল 'এক্সপেরিমেন্ট' 

বাবা মারা যাওয়ার পর মামারা এসে তাদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু মা চায় নি কারোর উপর নির্ভর করে বাঁচতে দরকারে অদরকারে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, হয়তো তাদের স্বার্থ ছিল , হয়তো ছিল না কিন্তু মা সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছিল মায়ের মতে আমাদের দেশে অসহায় একলা মেয়ে দেখলেই হায়নার দল হাঁ করে থাকে তাদের হাত থেকে বাঁচতে মা নিজেকে কঠিন আবরণে মুড়ে ফেলেছিল আজ অপা অনেক কিছু বুঝতে পারে 
সেদিন বাবার প্রভিডেন্ড ফান্ডের কয়েক হাজার টাকা সম্বল করে মা তাকে নিয়ে নতুন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল হয়তো মা একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিল মা কিন্তু তাতে আজ সফল 
মা কোনদিন ঠাণ্ডা ঘরে বসে অফিসে কাজ করার স্বপ্ন দেখেনি মা যে কাজটা ভালো জানতো সেটা সম্বল করে বাঁচার চেষ্টা করেছে সেই সময় তাদের এলাকায় খাবারের হোম ডেলিভারি সে ভাবে পরিচিত ছিল না প্রথম এক বছর কোনো রকমে চলেছিল তারপর থেকেই অবস্থা ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে নিত্য নতুন মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে তাদের এলাকায় নতুন দু-একটা ফ্ল্যাট, একটা ম্যানেজমেন্ট কলেজ গজিয়ে ওঠে এই এলাকায় বাড়তে থাকে মায়ের হোম ডেলিভারির গ্রাহক সংখ্যা চলতে থাকে মায়ের নিত্য নতুন খাবারের এক্সপেরিমেন্ট
ল্যাবে নিজের টেবিলে কম্পউটার স্ক্রিনে চোখ রেখেও অপা বুঝতে পারছিল ল্যাবের বাঁ-দিকের ওই টেবিলটা থেকে দুটো চোখ তার দিকে চেয়ে আছে শুধু আজ নয় বেশ কয়েকদিন থেকেই এটা ঘটছে কম্পিউটার মনিটরে দেখল 6টা বাজে অপা নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে উঠে পড়ল নিয়ম মাফিক সিকিউরিটি চেকিং এর পর সে ল্যাব বিল্ডিং এর বাইরে এসে দাঁড়াল ভাবছিল এখুনি নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে লাভ নেই, তার চেয়ে সামনের কফি-শপ টাতে কিছুক্ষন বসে গেলে ভালো হত হঠাৎ তার চোখে পড়ল সেই দুটো চোখের মালিক গেট পার হয়ে আসছে অপা আর দেরী না করে তড়িঘড়ি কম্পানীর গাড়িতে উঠে বসে, ড্রাইভারকে বলে তাকে অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিতে গাড়ির ভিউফাইন্ডারে দেখল ছেলেটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে 

কফির কাপ নিয়ে ফ্রেস হয়ে সবে মাত্র বসেছে, সেন্টার টেবিলে রাখা মোবাইলটা জানান দিল মোবাইলের অপর প্রান্তে কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করছেমোবাইলটা হাতে নিয়ে অপার মুখটা প্রশান্তিতে ভরে গেল তাড়াতাড়ি মোবাইলটা কানে দিয়ে বলে উঠল 
-
মা কেমন আছো তুমি ? খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করছ ? শরীর ঠিক আছে তো ? ব্লাডপ্রেশার চেক করেছ ? 
-
ওরে থাম থাম, একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দেব কি করে ? কিছু ভাবিস না আমি ঠিক আছি 
-
মা এবার তোমার কাজ একটু কমাও সারাজীবন তো পরিশ্রম করলে, আর কেন ? 
-
অপা তাই কি হয় মা ! কত অসহায় বৃদ্ধ বৃদ্ধা অপেক্ষা করে থাকে, কত ছেলেমেয়ে কলেজ থেকে ফিরে অপেক্ষা করে কখন টিফিনক্যারী এসে পৌঁছাবে তবে চিন্তা করিস না মা এখনতো আর একা হাতে করতে হয় না এখন শেফালী, মানদা, শঙ্কর, শিবু এরা সব আছে তো 
-
তা থাক, তবুও এবার তুমি অবসর নিয়ে আমার কাছে চলে এসো 
-
আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন তুই কেমন আছিস মা ? তোর কাজ কেমন চলছে ? 
-
আমি বিন্দাস আছি আর কাজ তো কিছু করি না, শুধু এক্সপেরিমেন্ট করে যাই কিভাবে আরও উন্নতমানের জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী করা যায় 
-
এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে নিজের শরীরের প্রতি নজর দিতে ভুলিস না যেন 
-
না মা, তুমি কিছু ভেবো না 
-
হ্যাঁ রে কিছু খেয়েছিস ? না শুধু কফির কাপ হাতে বসে পরেছিস ? 
-
না মানে এই তো 
-
বুঝেছি, যা এখুনি কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে বোস, খালি পেটে কফি খাস না মা 
-
হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি, তুমি ভালো থেকো মা 
মোবাইলটা রেখে কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইল অপা তারপর ধীরে ধীরে বিস্কুটের কৌটোটা নিয়ে এসে আবার ড্রয়িং রুমে এসে বসলো 

আজ মাস ছয়েক হয়েগেল সে একটা মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কম্পানীতে জুনিয়ার রিসার্চার হিসাবে যোগ দিয়ে এই ব্যাঙ্গালোরে এসেছে এই অ্যাপার্টমেন্ট টা কম্পানী থেকেই জোগাড় করে দিয়েছে কিন্তু ভাড়াটা নিজেকেই দিতে হয় শুধু যাতায়াতের জন্য কম্পানী নিজস্ব গাড়ী দিয়েছে 

ল্যাবরেটরীতে কাজের চাপ আজ একটু কম তাই আজ অপা কম্পিউটরে নিজের পুরানো প্রজেক্ট গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল হঠা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সেই চোখ দুটো আবার তারদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অপা আজ আর নিজেকে সামলাতে পারল না নিজের টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সটান হাজির হল ছেলেটির কাছে 
-
কি ব্যাপার বলুনতো ? আপনার কোন কাজ নেই ? 
-
কি ব্যাপার ? 
-
ন্যাকা, কিছুই যেন বুঝতে পারছেনা না ? 
-
না মানে 
-
না মানে কি ? বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ করছি যে আপনি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকেন, কেন বলুন তো ? 
-
না ইয়ে 
-
দেখুন এই বিদেশ ভুঁইএ এসে আপনাকে দেখে ভেবেছিলাম যাক একজন বাঙালী অন্তত এখানে আছে 
-
হ্যাঁ সে তো নিশ্চই 
-
চুপ করুন, কোনদিন কোন কথাতো আপনাকে বলতে শুনিনি, শুধু অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন ? 
-
না ঠিক তা নয় 
-
তা নয় মানে ! আপনার নাম তো তমাল রায় চৌধুরী তাই না ? 
-
হ্যাঁ 
-
আমার নাম জানেন ? 
-
হ্যাঁ জানি 
-
বাঃ , তাহলে কথা না বলে শুধুশুধু তাকিয়ে থাকেন কেন ? 
-
না আসলে ঠিক সাহস হয় না 
-
মানে ! আমি বাঘ না ভাল্লুক ! 
তমাল চুপ করে মাথা নিচু করে থাকে 
-
আপনার কাজ হয়েগেছে ? 
-
হ্যাঁ আজকের মতো প্রায় শেষ 
-
ঠিক আছে, ছুটির পর আমি সামনের কফি শপে অপেক্ষা করব,-চলেআসবেন 

অপা সামনের কফি শপে বসে ভাবছিল, কি ব্যাপার কে জানে! ছেলেটিকে দেখে খারাপ বলে তো মনে হয় না, কিন্তু ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কেন ? আমার থেকেও আরো সুন্দরী এই অফিসে আছে, তবে ! ওর মতলবটা কি ? মোবাইলে দেখল সাড়ে ছটা বাজে লোকটা কি আসবেনা ? দেরী করছে কেন ? 
দরজার দিকে তাকাতেই দেখল তমাল দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে সোজা অপার টেবিলের দিকে এগিয়ে এল সামনে আসতেই অপা বলল 
-
কি ব্যাপার এত দেরী করলেন যে! 
তমাল বসতে বসতে বলল - না মানে কাজগুলো সব গুছিয়ে আসতে একটু দেরী হয়ে গেল 
-
শুধু কফি খাবেন না সাথে অন্যকিছু বলবো ? 
-
আপনি বলবেন কেন! আমিই বলছি 
তমাল ওয়েটার কে ডেকে দুকাপ কফি আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে আসতে বলল 
অপা এবার বলল 
-
হ্যাঁ তমাল বাবু এবার বলুন 
-
কি বলবো ? 
-
কি বলবেন মানে ! আপনি কেন ওরকম হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন ? 
-
না মানে অপরাজিতা দেবী আমাকে ভুল বুঝবেন না 
-
ন্যাকা 
-
অ্যাঁ ! 
-
অ্যাঁ নয় হ্যাঁ আমি দেবী হতে যাবো কেন ? 
-
না মানে 
-
দেখুন আপনার এই মানে মানে করা বাদ দিন, সোজাসুজি বলুনতো 
-
না আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু না, আসলে আপনার নাম শুনে বুঝেছিলাম আপনি বাঙালী তাই একটু পরিচিত হওয়ার একটু কথা বলার লোভ হচ্ছিলো কিন্তু আপনাকে দেথে ঠিক সাহস করে উঠতে পারছিলাম না 
ওয়েটার এসে কফি আর স্ন্যাক্ল দিয়ে গেল
দুজনে কফিতে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইল 
-
দেখুন অপরাজিতা আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না, হ্যাঁ মানছি ওভাবে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা আমার অন্যায় হয়েছে, কিন্তু 
-
তা কিভাবে তাকালে ঠিক হত বলে আপনার মনে হয় ? 
-
মনে হচ্ছে ঝগড়া করাটাই আপনার প্রধান উদ্দেশ্য, বন্ধুত্ব করা মনে হয় ধাতে নেই সব কথার বাঁকা মানে করতেই বোধহয় আপনি ভালোবাসেন তাই না ? 
-
মানে ! 
-
মানে কিছু নেই আচ্ছা চলি তাহলে  
তমাল একটু রেগেই উঠে দাঁড়ালো অপরাজিতা তমালের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ওকে বসতে বলল তবুও তমাল দাঁড়িয়ে থাকে 
অপা অস্ফুটে বলল 
-
প্লিজ বসুন 
-
আর কি বলার আছে ! 
-
তমাল বাবু আমার মা বলেন আমাদের দেশে একা মেয়ে দেখলে হায়নার দল হাঁ করে থাকে তাই কোন মানুষ কে না জেনে তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াই কি করে ! 
-
তার মানে আপনার বিচারে আমি হায়না সম্প্রদায় ভুক্ত ? 
-
বসুন বসুন আর রাগারাগি করতে হবে না কিন্তু আপনি নিজেই বললেন যে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা আপনার অন্যায় হয়েছে 
-
হ্যাঁ সে তো আমি স্বীকার করেই নিয়েছি 
-
তাহলে সেই অন্যায়ের শাস্তিও তো আপনার প্রাপ্য, কি বলেন ? 
-
বলুন কি শাস্তি দিতে চান ? সবার সামনে আপনার পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে ? 
-
ছিঃ ছিঃ এতোটা খারাপ কিন্তু আমি নই আপনি কিন্তু এখনও রেগে আছেন 
-
ঠিক আছে , বলুন কি করতে হবে ? 
-
অফিস ছুটির পর প্রতিদিন আমাকে এই কফি শপে কফি খাওয়াতে হবে 
-
আমার অসুবিধা নেই, আপনি পারবেন তো ! 
-
লোকে কি বলবে সেই কথা বলছেন তো ? 
-
ঠিক তাই 
-
এখানে কেউ কারোর খোঁজ রাখে না আর কে কি বলল তা আমি কেয়ার করি না নিজের জীবনটা আমি নিজের মত বাঁচতে চাই 


কয়েকদিন ধরেই একটা সন্দেহ মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল সারা শরীরে একটা অসস্তী বোধ করছিল অপা না তমালকে কিছু বলা হয়ে ওঠে নি তমাল ব্যাপারটা কি ভাবে নেবে তা নিয়ে সন্দেহ ছিল 
কিন্তু আজও যখন মাসের বিশেষ শারীরিবৃত্তীয় প্রক্রিয়া টি হলো না তখন সন্দেহ আরো জোরালো হয়ে উঠল 
আজ ইচ্ছা করেই ল্যাবের কাজে একটু দেরী করে ফেলল তমাল কে বলল আমার কাজ একটু বাকী আছে, তুমি বাড়ি যাও আমি পরে আসছি তমাল বলেছিল যে কাজ সেরে নাও আমি অপেক্ষা করছি, দুজনে একসাথেই যাবো কিন্তু অপা একরকম জোর করেই তমালকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় 
তমাল চলে যাওয়া বেশ কিছুক্ষন পরে অপা অফিস থেকে বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার আগে ওষুধের দোকান থেকে একটা প্রেগনেন্সি কিট কিনে ব্যাগে ভরে নেয় 
বাড়ি ফিরে দরজা নক্ করতে যেতেই দেখে দরজা খোলা আছে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভিতরে আসে দেখে তমাল ফ্রেশ হয়ে টিভির সামনে বসে আছে ওকে দেখে তমাল একটু হাসে অপা প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে বেডরুমে এসে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পরে অনেকক্ষন অপার কোন সাড়া না পেয়ে তমাল বেডরুমে এসে দেখে অপা শুয়ে আছে 
-
কি হল শরীর খারাপ লাগছে ? 
-
না না তুমি বসো, আমি ফ্রেস হয়ে চা নিয়ে আসছি 
অপা টাওয়ালটা আলনা থেকে নিয়ে বাথরুমে এসে শাওয়ার চালিয়ে তার নিচে দাঁড়ায় ভাবে তমালকে কিভাবে বলব কে জানে ! রেজাল্ট যদি পজেটিভ হয় তাহলে ! আচ্ছা এতে তমালের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই ! মা যদি জানতে পারে মাকে কি জবাব দেব ! সব কিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে কতক্ষন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েছিল জানেনা হঠা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পরতে চিন্তার সুতোটা কেটে গেল বাইরে তমালের গলা - অপা এই অপা কি হল ? ঠিক আছো তো ? অপা ! অপা ! 
অপা গায়ে টাওয়াল জড়িয়ে বেড়িয়ে এল, বলল - খুব গরম লাগছিল বুঝলে তাই একটু বেশীক্ষন স্নান করলাম, তুমি যাও আমি আসছি 

চা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে কাপে চা ঢালছিল অপা তমাল টিভির সামনে থেকে উঠে এসে ডাইনিং এর একটা চেয়ার টেনে বসল অপা অন্যমনষ্ক ভাবে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল তমাল চুপচাপ অপাকে দেখে চলেছে অপা নিজের কাপে চামচটা নাড়তে নাড়তে ভাবছিল আজ থাক, আজ আর তমালকে কিছু জানাবো না শিওর হয়ে কাল না হয় বলবো তারপর কি মনে হতে তমালের দিকে চোখ তুলে তাকাল, দেখল তমাল ওর দিকে তাকিয়ে আছে তমাল বলল কিছু বলবে ? অপা একটু ইতস্তত করে বলল - দেখ তমাল আমি ঠিক শিওর নই তবে সন্দেহ হচ্ছে 
-
কি ব্যাপারে ? 
-
না মানে আই থিঙ্ক আই এ্যাম প্রেগনেন্ট 
তমাল কিছুক্ষন চুপ করে অপার দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর কিছু না বলে চুপচাপ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে টিভির সামনে গিয়ে বসে পড়ল 
তমালের এই ব্যাবহারে অপা অবাক হয়েগেল 


রাত এখন গভীর ওপাশে তমাল নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেঅপা ঘরের ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে ভাবে এইতো বেশী দিনের কথা নয়, মাত্র দুবছর আগে তারা দুজনে মিলে এই একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অফিস থেকে বেড়িয়ে কফি-শপে যাওয়া প্রায় দুজনার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল কিছুটা সময় দুজনে সামনা সামনি বসে থাকা, পরস্পরের সুখ-দুঃখের কথা বলা এই ভাবেই চলছিল এভাবেই হয়তো দুজনার মনের কোনে প্রেম বাসা বেঁধেছিল 
তমালই প্রথম প্রোপজ করে, অপার অসম্মতি ছিল না সুতরাং দুজনার সম্পর্কটা গাঢ় হতে বিশেষ সময় লাগেনি দুজনার বংশ পরিচয় নিয়ে কারোরই মাথা ব্যাথা ছিল না 
সেদিন বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি অফিস থেকে বেড়িয়ে কফি-শপে যাওয়াও দুষ্কর তমাল বলল আজ মনে হচ্ছে আর কফি নিয়ে বসা হবে না অপা বলে কেন হবে না চলো আমার ফ্ল্যাটে যাই সেইমত তারা অপার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় তমাল কম্পানী থেকে ফ্ল্যাট পেলেও নেয়নি ওর পক্ষে কম্পানীর গেষ্টহাউসই ছিল সুবিধাজনক 
সেইদিন প্রথম প্রস্তাবটা আসে তমালের তরফ থেকেই তমাল বলেছিল - এভাবে আর কতদিন আলাদা থাকবো 
অপা বলল - দেখ এই মুহুর্তে আমি বিয়ের কথা ভাবছি না দুজনে দুজনকে আরো কিছুটা জানি তারপর না হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে 
-
না আমি ঠিক বিয়ের কথা বলছি না 
-
তবে ! তমাল তুমিও কি অন্যদের মতো সুযোগ নিতে চাইছো ! 
-
না অপা তুমি ভুল বুঝছো দেখ শুধু কফি- শপের কয়েক মুহুর্তে কেউ কাওকে জানতে পারবো না দুজনার যদি দুজনকে জানতে হয়, বুঝতে হয় তাহলে কাছাকাছি পাশাপাশি থাকতে হবে 
-
মানে ! 
-
দেখ আমাদের দেশে হয়তো এটা অন্য ভাবে দেখা হয় কিন্তু অন্যান্য দেশে লিভটুগেদার খুব সাধারণ ব্যাপার 
-
তমাল তুমি কি বলছ ! 
-
কেন অপা এতে খারাপটা কি ? 
-
দেখ শরীর নিয়ে আমার কোন শুচিবাই নেই কিন্তু সমাজ কি বলবে ? তোমার পরিবার মেনে নেবে ? 
-
আমার পরিবার কি ভাবল না ভাবল তা নিয়ে আমি ভাবি না 
-
কিন্তু এরপর যদি দুজনার দুজনকে ভালো না লাগে তখন ? 
-
অপা এই ভালো না লাগা থেকেই কিন্তু বিয়ের পরও বিচ্ছেদ হয় 
-
কিন্তু পাশাপাশি থাকতে গেলে শরীরতো আসবেই ! 
-
সে তো দুজনার বোঝাপড়ার ব্যাপার 
-
আমার শরীরটা পাওয়া হয়েগেলে তুমি যে আমার কাছে থাকবে তার নিশ্চয়তা কোথায় ? 
-
অপা সবকিছুই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমি শুধু তোমায় একটা প্রস্তাব দিলাম যদি তোমার ভালো নাও লাগে তবুও আমি এখনকার মতোই তোমার পাশেই থাকবো 
-
তমাল আমাকে একটু সময় দাও 
-
নিশ্চ, আমিতো আজ থেকেই শুরু করতে বলিনি 
এরপর কেটে যায় আরও দুমাস এর মধ্যে প্রতিদিন দুজনে কফি-শপে বসেছে না তমাল আর কোন জোর করেনি এই দুমাস অপার মনে প্রবল আলোড়ন চলে জীবন নিয়ে এই নতুন এক্সপেরিমেন্ট তারে প্রবল আকর্ষন করে, কিন্তু ভবিষ্যতের দিশা না পেয়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তমালের পরিবারও এই লিভটুগেদার মানতে নারাজ, কিন্তু তমাল নিজের সিদ্ধান্তে অনড় 
অপা শেষ পর্যন্ত মাকে বলেই ফেলল মা শুধু বলল - দেখ মা তোর কোন কাজে আমি কোনদিন বাধা দিই নি এই লিভটুগেদার আমার কাছে ঠিক সহজবোধ্য নয় তবে এক র্থে বিয়ের পরও কিন্তু আমরা এই লিভটুগেদরই করি দুজনার মাঝে বিশ্বাসটাই আসল জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট কর ক্ষতি নেই তবে জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করিস না 
অপা মায়ের কথা শুনে একটু আস্বস্থ হয় ভাবে দেখিই না একবার, পরের কথা পরে ভাবা যাবে তমাল কে ফোন করে শুধু বলে - আমি রাজী কিন্তু তার আগে আমি তোমার সাথে খোলাখুলি আরও কিছু কথা বলতে চাই 
কথা মতো তমাল অপার ফ্ল্যাটে চলে আসে 
-
বল তুমি কি জানতে চাও ? 
-
তোমাকে কতটা বিশ্বাস করতে পারি ? 
-
অপা এটার তো কোন উত্তর হয়না বিশ্বাস করা বা না করা সম্পূর্ন তোমার উপর আমি যদি বলি আমাকে সম্পূর্ন বিশ্বাস করতে পারো, তাহলে কি তুমি মেনে নেবে ? 
তবে একটা কথা তোমায় দিতে পারি তোমার সম্মতি ছাড়া ভবিষ্যতে কোন কিছুতেই আমি কোন জোর করব না 
-
যদি কখনও আমার আর তোমাকে ভালো না লাগে তখন ! 
-
আমি নিঃশর্তে সরে যাবো কোন অনুযোগ করব না 
-
আর যদি উল্টটা হয় ? 
-
যাওয়ার আগে তোমাকে কারন জানিয়ে যাব 
-
জীবনের এই অধ্যায়টা আমি আমার ফ্ল্যাটেই শুরু করতে চাই 
-
বেশ তাই হবে আমি তোমার আশ্রিত হয়ে থাকব 
আজ প্রায় দুবছর হয়েগেল তারা একসাথে আছে প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগত কিন্তু পরের দিকে তমাল কেমন যেন একটু হয়েগেল মাঝে মধ্যে অপার মনে হত তবে কি ভুল করলাম ! না তমাল কোনদিন ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে নি কিন্তু অপা চেয়েছিল তমালের মধ্যে কিছুটা দায়ীত্ববোধ দেখতে হয়তো লিভটুগেদারে একে অপরের প্রতি দায়বধ্যতা থাকে না, কিন্তু ভালোবাসার সম্পর্কতো মিথ্যা নয় সেই ভালোবাসার টানেও তো একে অপরের প্রতি দায়বধ্যতা থেকে যায় কিন্তু তমালের উদাসীন ভাব অপাকে ভাবিয়ে তুলতো স্বাভাবিক ভাবেই এই সম্পর্কে শরীর এসেছে এবং অবশ্যই তা অপার সম্মতিতে সেদিন কি যে হল, মুহুর্তের উত্তেজনায় এত বড় ভুল কিভাবে যে হয়েগেল ! 
এইসব ভাবতে ভাবতে অপা ঘুমিয়ে পরেছিল হঠাত্ঘুম ভেঙে অপা ধড়মড় করে উঠে বসে দেওয়ালে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে সাড় চারটে বাজে একরাশ চিন্তা নিয়ে অপা বাথরুমে দৌড়য় সকালের প্রথম ইউরিন কালেক্সশনের জন্য  সময় সশব্দে জানান দিয়ে এগিয়ে চলে টেষ্ট কিটের নির্দিষ্ট জায়গায় ইউরিন দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মাত্র তিরিশ সেকেন্ত কিন্তু অপার মনে হয় একযুগ বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে তমাল উপুর হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে 
টেষ্ট কিটে ধীরে ধীরে টেষ্ট লাইন জেগে ওঠে, তারপর কন্ট্রোল লাইনও দেখা যায় অপার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অবশেষে অপেক্ষার অবসান অপা নিজেকে গুছিয়ে নেয় মনটাকে বেঁধে ফেলে নিজের মধ্যে
বাইরে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে অপা ধীর পায়ে রান্নাঘরে যায় অভ্যাস মতো দু-কাপ চা করে নিয়ে বসার ঘরে এসে বসে দেখে তমাল উঠে পরেছে অপা চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকার পর অপা তমালের দিকে তাকিয়ে বলে

- তমাল আমি সত্যি সত্যি মা হতে চলেছি 
তমাল যেন চমকে ওঠে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলে - অপা, আমি এই মুহুর্তে এসবের জন্য প্রস্তুত নই প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না 
-
না তমাল কোন টেনশন নিও না, আমি ঠিক সামলে নেব  
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অপা রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়ায় 
তমাল একদৃষ্টে অপাকে দেখে যায় অপা তমালের চোখে চোখ রেখে বলে 
-
চা টা একটু ঠান্ডা হয়েগেছে আবার নতুন করে বানাতে হবে জানো এই চা বানানো বড্ড বিরক্তিকর ভাবছি নতুন একটা এক্সপেরিমেন্ট করবো, চা বানানোর চটজলদী কিছু সমাধান নতুন যে আসছে তারজন্য কিছু বাড়তি সময় দিতে হবে তো
হ্যাঁ তুমি তোমার জন্য অন্য কোথাও থাকার ব্যাবস্থ করে নিও 
অপা ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায় তার নতুন এক্সপেরিমেন্টের দিকে 
*******
সমাপ্ত ********

মন্তব্যসমূহ

  1. বলিষ্ঠ লেখা। শেষ টা, মন ভরিয়ে দিলো। এই শেষ টা 'Arth' cinemar শেষ টার কথা মনে করিয়ে দিলো।

    উত্তরমুছুন
  2. তোমার লেখার প্লট চিরকালই মারকাটারি, এটাও তাই। আর মানুষের মনের জোর, বিশেষত মহিলাদের, বারবার লেখায় ফুটে ওঠে বিভিন্নভাবে। আর লেখাটায় সময় যেভাবে সুন্দর একটা পর্যায় থেকে আরেকটা পর্যায়ে গেছে, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার পরেও রেশ রয়ে গেল। থাকবেও।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। শেষটা তো অসাধারন। ভারি সুন্দর লেখা।।অসামান্য লেখা। কলম চলতে থাকুক।

    উত্তরমুছুন
  4. দারুণ.. খুব ভালো লাগলো.. শেষ টা তো দূর্দান্ত..

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস