অমল ও একটি গল্প
অমল এখন আর জানলার ধারে বসে থাকে না। সেই
ছোটবেলায়
রবি
ঠাকুরের
গল্প
পড়ে
সেও
দইওয়ালার
পথ
চেয়ে
থাকত। কিন্তু দইওয়ালা এলেও তার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি কোনদিন। বিনিপয়সায়
কেউ
সখ্যতা
গড়েনা
আর।
ধীরে ধীরে সেই দইওয়ালাও একদিন হারিয়ে যায়। জানলার সামনে উন্মুক্ত আকাশটা লম্বা গলাওয়ালা বাড়িগুলোর পিছনে হারিয়ে যায়। একফালি আকাশ যে চোখে পড়েনা তা নয়, কিন্তু মন ভরে না। ছেলেবেলার স্বপ্নগুলো ভাঙতে ভাঙতে আজ যখন বাস্তবকে দেখে তখন বস্তির এই ছোট্ট ঘরে মা -বাবার কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
বাবা গত হওয়ার পর কিছু স্বপ্ন তবুও টিকেছিল। মা ছেলের চলে যেত কোন রকমে। কিন্তু হঠাত্ একদিন মা কাজের বাবুদের বাড়ি থেকে আর ফিরে এল না। দিন তিনেক পরে বস্তির কিছু লোক এসে বলল - অমল তোর মা কে পাওয়া গেছে, উই রেল লাইনের পাশে।
পুলিশ এলো , কিছু অকথা কুকথা শোনালো তারপর সব চুপচাপ। যেটুকু সঞ্চয় ছিল তাতে করে মাকে পরপারে যাত্রা করিয়ে আর কিছুই প্রায় হাতে বাকী থাকল না। দুদিন কোনরকমে দুপুরের খাবারটা জুটেছিল। কাজের বাবুদের বাড়িতেও গিয়ে ছিল অমল , কিন্তু বাবুদের কাছে জুঠে ছিল কিছু ঞ্জান আর ঘাড় ধাক্কা।স্কুলের খাতাও বন্ধ হয়েগেল। রবি ঠাকুর আর তার স্বপ্নেরা রয়েগেল বইয়ের পাতাতে। পেটের খিদে বড় বিষম বস্তু । অমল এখানে ওখানে চেষ্টা করেছিল যদি কিছু কাজ পাওয়া যায়, কিন্তু কাজ দেয়নি কেউ। ঝান্ডাওয়ালা দাদারাও মুখ ফিরিয়ে নিল। শেষে বস্তির উপেন বলল - দেখ অমল কাজের একটা ব্যাবস্থা করতে পারি কিন্তু তুই কি পারবি এই সব কাজ করতে ?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ পারব , তুমি বল কি করতে হবে? আমি ঠিক পারব।
~ ঠিক আছে তাহলে সন্ধ্যেবেলা আসিস আমি বুঝিয়ে দেব।
বস্তির উপেন, উপেন মাহাতো - লোক হিসাবে খারাপ নয় কিন্তু অমল কানাঘুষোয় শুনেছে যে তার কাজ কারবার ঠিক নয়।
নাঃ বাবা ঠিক বেঠিক নিয়ে চিন্তা করলে আমার পেট ভরবে না , অমল মনে মনে ভাবল।
সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে অমল উপেনের ঠেকে গিয়ে পৌঁছাল।
~ ও তুই এসেগিয়েছিস , একটু বোস আমি আসছি এখনি।
একটু পরে উপেন একটা বড়সর থলি নিয়ে এসে বলল - এই নে, আজ আর এর থেকে বেশী পাবিনা।যেরকম বিক্রি হবে সেরকম পয়সা পাবি , আর বড়চালার রাস্তাটুকুতেই শুধু বেচবি।
থলের ভিতর মালপত্র দেখে আর বড়চালার নাম শুনেই অমলের মুখটা শুকিয়ে গেল।
উপেন বলল কিরে পারবি না আমি অন্য কোন লোক দেখব ?
অনেক কষ্টে চোখের জল চেপে অমল বলল - না দাও আমি পারব।
শুরু হল অমলের নতুন জীবন ।
***************************************************************************************************
রাতের আঁধারে বড়চালার ল্যাম্পপোষ্টের আলো গুলো বড় মায়াবি লাগে। আলোর নিচে রঙচঙে মেয়েগুলো মায়াবিনী না অশরীরী মাঝে মধ্যে ধন্দ লেগে যায় অমলের।
অমল এখন পাউচওয়ালা। না না জলের পাউচ নয় , ধেনমদের পাউচ বিক্রি করে অমল।বড়চালায় ফুর্তি করতে আসা লোকগুলো ওর প্রধান খরিদ্দার। মায়াবিনীরাও যে কেনেনা তা নয় ওই কখনও সখনও।
প্রথম প্রথম অমলের অস্বস্থি লাগত , কান্নাও পেত। এখন আর কিছু মনে হয়না। বড়চালার ছোট ছোট খুপরী গুলোতে আলো ছায়ার শরীরী খেলা গা সওয়া হয়ে গেছে।
ওর কাজের সময় সন্ধ্যে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। এখন যে বড়চালার পরিচিত মুখ।বিক্রি বেশ ভালোই। হিসাব নেওয়ার সময় উপেন বেশ খুশীই হয়। মাঝে মধ্যে দু-দশ টাকা বকসিসও জুটে যায়।
যেদিন লোকের আনাগোনা কম থাকে সেদিন আর তেমন পাউচ বিক্রি হয় না। গুটি কয়েক পাউচ ওই বড়চালার মায়াবীনি মেয়েগুলো কেনে, ব্যাস ব্যাবসা শেষ। মাঝে মধ্যে ওদের সাথে গল্পেও মেতে যায় অমল। ওদের সাথ কথা বলে এটুকু বুঝেছে যে সবকিছুর মূলে সেই পেটের টান।
এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছুদিন। অমলও কৈশর পেরিয়ে গেল এই গত মাসে।
আজ সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। কেন জানিনা সকাল থেকেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে অমলের।সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে পাউচের থলি নিয়ে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে অমল। আজ খরিদ্দারের আনাগোনা খুব একটা বেশী নয়। রাত বেড়ে চলে। কয়েকদিন ধরেই নতুন একটি মুখ চোখে পড়ছে অমলের। রাস্তার শেষের কয়েকটা খুপরীর আগে যে ল্যাম্পপোষ্টটা আছে ঠিক তার পাশেই মেয়েটিকে দেখে সে। শ্যামলা রঙের মেয়েটির চোখদুটি বড় মায়াবী লাগে অমলের। যাওয়া আসার সময় আড়চোখে দেখে সে। আজও দেখে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয় অমল। ধীরে ধীরে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যায়।
~ কি রে তুই এত রাতে এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস ?
মেয়েটি চোখ তুলে তাকায় , বলে
~ আজ আমার কপাল খারাপ গো , কোন বাবুর মনে ধরেনি আমাকে।
~ তোর নাম কি ?
হেসে ফেলে মেয়েটি বলে
~ নাম জেনে কি করবে গো ? এখানে কেউ আসল নাম বলে নাকি ?
~ না নাম জেনে আর কি করব, এমনিই শুধালাম।
~ আমার নাম পাখি। তা তোমার নাম কি ? পাউচওয়ালা ? না অন্য কোন নাম আছে ?
~ আছে , অমল ।
~ আচ্ছা অমল তুমি কখনও এই পাউচ মুখে দিয়ে দেখছ কেমন লাগে খেতে ?
ধীরে ধীরে সেই দইওয়ালাও একদিন হারিয়ে যায়। জানলার সামনে উন্মুক্ত আকাশটা লম্বা গলাওয়ালা বাড়িগুলোর পিছনে হারিয়ে যায়। একফালি আকাশ যে চোখে পড়েনা তা নয়, কিন্তু মন ভরে না। ছেলেবেলার স্বপ্নগুলো ভাঙতে ভাঙতে আজ যখন বাস্তবকে দেখে তখন বস্তির এই ছোট্ট ঘরে মা -বাবার কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
বাবা গত হওয়ার পর কিছু স্বপ্ন তবুও টিকেছিল। মা ছেলের চলে যেত কোন রকমে। কিন্তু হঠাত্ একদিন মা কাজের বাবুদের বাড়ি থেকে আর ফিরে এল না। দিন তিনেক পরে বস্তির কিছু লোক এসে বলল - অমল তোর মা কে পাওয়া গেছে, উই রেল লাইনের পাশে।
পুলিশ এলো , কিছু অকথা কুকথা শোনালো তারপর সব চুপচাপ। যেটুকু সঞ্চয় ছিল তাতে করে মাকে পরপারে যাত্রা করিয়ে আর কিছুই প্রায় হাতে বাকী থাকল না। দুদিন কোনরকমে দুপুরের খাবারটা জুটেছিল। কাজের বাবুদের বাড়িতেও গিয়ে ছিল অমল , কিন্তু বাবুদের কাছে জুঠে ছিল কিছু ঞ্জান আর ঘাড় ধাক্কা।স্কুলের খাতাও বন্ধ হয়েগেল। রবি ঠাকুর আর তার স্বপ্নেরা রয়েগেল বইয়ের পাতাতে। পেটের খিদে বড় বিষম বস্তু । অমল এখানে ওখানে চেষ্টা করেছিল যদি কিছু কাজ পাওয়া যায়, কিন্তু কাজ দেয়নি কেউ। ঝান্ডাওয়ালা দাদারাও মুখ ফিরিয়ে নিল। শেষে বস্তির উপেন বলল - দেখ অমল কাজের একটা ব্যাবস্থা করতে পারি কিন্তু তুই কি পারবি এই সব কাজ করতে ?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ পারব , তুমি বল কি করতে হবে? আমি ঠিক পারব।
~ ঠিক আছে তাহলে সন্ধ্যেবেলা আসিস আমি বুঝিয়ে দেব।
বস্তির উপেন, উপেন মাহাতো - লোক হিসাবে খারাপ নয় কিন্তু অমল কানাঘুষোয় শুনেছে যে তার কাজ কারবার ঠিক নয়।
নাঃ বাবা ঠিক বেঠিক নিয়ে চিন্তা করলে আমার পেট ভরবে না , অমল মনে মনে ভাবল।
সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে অমল উপেনের ঠেকে গিয়ে পৌঁছাল।
~ ও তুই এসেগিয়েছিস , একটু বোস আমি আসছি এখনি।
একটু পরে উপেন একটা বড়সর থলি নিয়ে এসে বলল - এই নে, আজ আর এর থেকে বেশী পাবিনা।যেরকম বিক্রি হবে সেরকম পয়সা পাবি , আর বড়চালার রাস্তাটুকুতেই শুধু বেচবি।
থলের ভিতর মালপত্র দেখে আর বড়চালার নাম শুনেই অমলের মুখটা শুকিয়ে গেল।
উপেন বলল কিরে পারবি না আমি অন্য কোন লোক দেখব ?
অনেক কষ্টে চোখের জল চেপে অমল বলল - না দাও আমি পারব।
শুরু হল অমলের নতুন জীবন ।
***************************************************************************************************
রাতের আঁধারে বড়চালার ল্যাম্পপোষ্টের আলো গুলো বড় মায়াবি লাগে। আলোর নিচে রঙচঙে মেয়েগুলো মায়াবিনী না অশরীরী মাঝে মধ্যে ধন্দ লেগে যায় অমলের।
অমল এখন পাউচওয়ালা। না না জলের পাউচ নয় , ধেনমদের পাউচ বিক্রি করে অমল।বড়চালায় ফুর্তি করতে আসা লোকগুলো ওর প্রধান খরিদ্দার। মায়াবিনীরাও যে কেনেনা তা নয় ওই কখনও সখনও।
প্রথম প্রথম অমলের অস্বস্থি লাগত , কান্নাও পেত। এখন আর কিছু মনে হয়না। বড়চালার ছোট ছোট খুপরী গুলোতে আলো ছায়ার শরীরী খেলা গা সওয়া হয়ে গেছে।
ওর কাজের সময় সন্ধ্যে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। এখন যে বড়চালার পরিচিত মুখ।বিক্রি বেশ ভালোই। হিসাব নেওয়ার সময় উপেন বেশ খুশীই হয়। মাঝে মধ্যে দু-দশ টাকা বকসিসও জুটে যায়।
যেদিন লোকের আনাগোনা কম থাকে সেদিন আর তেমন পাউচ বিক্রি হয় না। গুটি কয়েক পাউচ ওই বড়চালার মায়াবীনি মেয়েগুলো কেনে, ব্যাস ব্যাবসা শেষ। মাঝে মধ্যে ওদের সাথে গল্পেও মেতে যায় অমল। ওদের সাথ কথা বলে এটুকু বুঝেছে যে সবকিছুর মূলে সেই পেটের টান।
এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছুদিন। অমলও কৈশর পেরিয়ে গেল এই গত মাসে।
আজ সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। কেন জানিনা সকাল থেকেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে অমলের।সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে পাউচের থলি নিয়ে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে অমল। আজ খরিদ্দারের আনাগোনা খুব একটা বেশী নয়। রাত বেড়ে চলে। কয়েকদিন ধরেই নতুন একটি মুখ চোখে পড়ছে অমলের। রাস্তার শেষের কয়েকটা খুপরীর আগে যে ল্যাম্পপোষ্টটা আছে ঠিক তার পাশেই মেয়েটিকে দেখে সে। শ্যামলা রঙের মেয়েটির চোখদুটি বড় মায়াবী লাগে অমলের। যাওয়া আসার সময় আড়চোখে দেখে সে। আজও দেখে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয় অমল। ধীরে ধীরে মেয়েটির কাছে এগিয়ে যায়।
~ কি রে তুই এত রাতে এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস ?
মেয়েটি চোখ তুলে তাকায় , বলে
~ আজ আমার কপাল খারাপ গো , কোন বাবুর মনে ধরেনি আমাকে।
~ তোর নাম কি ?
হেসে ফেলে মেয়েটি বলে
~ নাম জেনে কি করবে গো ? এখানে কেউ আসল নাম বলে নাকি ?
~ না নাম জেনে আর কি করব, এমনিই শুধালাম।
~ আমার নাম পাখি। তা তোমার নাম কি ? পাউচওয়ালা ? না অন্য কোন নাম আছে ?
~ আছে , অমল ।
~ আচ্ছা অমল তুমি কখনও এই পাউচ মুখে দিয়ে দেখছ কেমন লাগে খেতে ?
~ না
আমি
ওসব
খাইনা।
~ সে কি গো মাল বেচ আর মালের স্বাদ জাননা !
~ কেন ! বেচলেই খেতে হবে নাকি !
একটু রেগেই যায় অমল।
~ আহা তুমি এত রাগ করছ কেন ?
~ না রাগ করার কি আছে , আর তুই আমার কে যে তোর কথায় আমি রাগ করব !
মেয়েটা চুপ করে যায়।
রাত বাড়তে থাকে। অমল ধীরে ধীরে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে।
********************************************************************************
দিন যায়। কখনও সখনও রাতের বেলা মেয়েটির সাথে কথা হয়, কখনও শুধু চোখে চোখ পড়ে।
মাঝে মধ্যে একটু রাতে মেয়েটি যখন বাইরে এসে বসে, অমলও ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসে। এই রকমই একদিন ক্লান্ত শরীরে মেয়েটি বসেছিল চুপ করে। অমলেরও থলি প্রায় খালি হয়ে এসেছে। পায়ে পায়ে মেয়েটির পাশে এসে বসে অমল।হঠাত্ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখে ওর ডাগর চোখ দুটি জলে ভরা। অমল বলে -
~ এই পাখি তুই কাঁদছিস ?
~ কই ? কাঁদছি নাতো।
~ মিছে কথা কেন বলছিস ?
~ না আসলে আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, তাই।
~ আচ্ছা পাখি তুই এখানে এলি কি করে ?
~ আমি আসিনি, আমাকে জোড় করে এখানে নিয়ে এসেছে।
~ কেন?
~ বাবা মারা যাওয়ার পর সত্ মা বিয়ের নাম করে দালালের হাতে আমাকে বেচে দিল। তারপর সেই লোকটা কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরিয়ে এখানে এনে পাকাপাকি ভাবে খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়।
জান অমল প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, খুব কান্না পেত। এখন আর চোখে জল আসেনা। শুধু আমার মার কথা মনে পড়লে মনটা কেঁদে ওঠে।
~ তুই পালাতে পারিসনা পাখি ?
~ পালাবো ? এখান থেকে ? জানোনা এখান থেকে পালানো যায় না, আর পালিয়ে যাব কোথায় ! আমার তো কেউ নেই।
~ তোর খুব কষ্ট তাই না রে ?
~ আমার কষ্টতো তোমার কি ? আমি তোমার কে ?
~ না, কেউ না।
অমল উঠে পড়ে, যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায়। হঠাত্ নিচু হয়ে মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে - তুই আমার রাতপাখি।
বলেই হনহন করে হাঁটা লাগায়।
অবাক চোখে চেয়ে থাকে পাখি।
**********************************************************************************
পরদিন বড়চালায় লোকের আনাগোনা একটু বেশীই ছিল। অমলের ব্যাস্ততাও বেড়ে যায়।
তবে কাজের ফাঁকে তার চোখ রাতপাখিকে খুঁজে বেড়ায়।
রাত তখন বেশ গভীর, অমল ঘরের পথে পা বাড়ায়। হঠাত্ কেউ ওকে ডাকে - এই পাউচওয়ালা।
অমল ঘুরে তাকায়। দেখে তার রাতপাখি দাঁড়িয়ে।
~ আমার একটা নাম আছে জানিসনা !
~ তা আছে। কিন্তু সবাইতো তোমায় পাউচওয়ালা বলেই ডাকে।
~ তা বলে তুইও ডাকবি !
~ কেন ? আমি ডাকলে কি হবে ? আমি তোমার কে ?
অমল চুপকরে থাকে।
~ কি হলো বললেনা তো ?
~ রাতপাখি।
~ কেন ? আমি রাতপাখি কেন ?
~ বা রে তোকেতো শুধু রাতেই দেখি তাই।
দুজনেই চুপচাপ।
~ তুই রাগ করলি পাখি ? আচ্ছা , আয় এখানে এসে বোস।
দুজনে চুপচাপ বসে থাকে পাশাপাশি। হঠাত্ মেয়েটি বলল -
~ আমাকে এই নরক থেকে নিয়ে যাবে অমল ?
~ তুই যাবি আমার সাথে !
~ সাধতো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু আমি জানি তা সম্ভব নয়।
~ কেন ? সম্ভব নয় কেন ?
~ না কিছু না, অনেক রাত হল যাও তুমি বাড়ি যাও।
মেয়েটি চলে যায়। অমল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
**************************************************************************************************
কয়েকদিন পরের কথা, সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আকাশের মুখ ভার। চারিদিক থমথম করছে। বড়চালাতেও লোকের আনাগোনা কম, প্রায় নেই বললেই চলে।
অমল অভ্যেস মতো রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজ তার বাজার মন্দা। হঠাত্ ঝড় উঠল তার সাথে বৃষ্টি। সে দৌড়ে একটা খুপরীর চালের নিচে আশ্রয় নিল। মাথাটা বাঁচল, কিন্তু জামা-প্যান্টে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছিল। হঠাত্ খুপরীর দরজাটা খুলেগেল। কেউ একজন বলে উঠল - ভিতরে এসে বসো নাহলে ভিজে যাবে।
অমল তাকিয়ে দেখল পাখি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সে পাখির খুপরীর চালের নিচেই আশ্রয় নিয়েছে।
~ কি হলো ! এসো !
~ না ঠিক আছে।
~ কেন আমার ঘরে আসতে ঘেন্না হচ্ছে বুঝি ?
~ না তা কেন ! আচ্ছা চল।
~ বসো ।
অগত্যা অমল খাটের উপরই বসল। মেয়েটিও তার পাশে বসে পড়ল।
কিছুক্ষন পর অমল বলল -
~ আচ্ছা পাখি, তুই সেদিন আমার সাথে এখান থেকে যাওয়ার কথা বললি, সত্যি যাবি তুই আমার সাথে!
পাখি চুপ করে রইল।
~ কি হল বল।
~ তা হয়না অমল।
~ কেন হয় না পাখি ! কেন ?
~ আমি যে অপবিত্র, অসতী, কেমন করে আমি এ জীবন থেকে মুক্তি পাব ! হয়না এ হয়না অমল।
~ তুই যে আমার রাতপাখি। জানিস আমার মা বলতো কেউ ইচ্ছা করে খারাপ হয়না, খারাপ হয় তার কপালের দোষে আর পেটের টানে।
~ কিন্তু অমল তোমার রাতপাখির জীবনে এই রাতটাই যে ভয়ঙ্কর সত্যি।
অমল খুপরীর জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। জানলা দিয়ে এক ফালি আকাশের তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল -
~ পাখি তুই রাতের আকাশের তারা দেখেছিস ? তারা কিন্তু রাতেই দেখা যায়।
পাখি পায়ে পায়ে এসে অমলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
~ ওই দেখ পাখি ওইযে তারাটা ওটা অরুন্ধুতী, আর ওইটা ওটা রোহীনি। জানিস , এরা সবাই কিন্তু পবিত্র সবাই সতী কিন্তু রাতে ছাড়া এদের দেখা পাবি না।
~ কিন্তু অমল
~ কোন কিন্তু না, তুই যে আমার রাতপাখি।
~ আমার বড় ভয় করছে যদি কেউ জানতে পারে তাহলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।
~ আমার উপর ভরসা রাখ। কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু হতে দেব না।
অমলের কাঁধে মাথা রাখে পাখি। দুজনের স্বপ্ন মিলেমিশে এক হয়ে যেতে থাকে, রাত গভীর হয়।
****************************************************************************************************
পাখি জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এল, অমলতো এখনও ফিরে এল না, এত দেরী কেন হচ্ছে কেন ?
তারপরই সে অমলকে দেখতে পায়, ক্লান্ত শরীরে ধীর পায়ে বাড়ীর দিকেই আসছে।
~ কি গো এত দেরী হল ?
~ আজ কাজ একটু বেশী ছিল, মালিক বলল আজকের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে তাই দেরী হয়েগেল।
না অমল এখন আর পাউচ বিক্রি করে না। বস্তি ছেড়ে অন্য শহরে এসে বাসা বেঁধেছে তার রাতপাখির সাথে।
~ সে কি গো মাল বেচ আর মালের স্বাদ জাননা !
~ কেন ! বেচলেই খেতে হবে নাকি !
একটু রেগেই যায় অমল।
~ আহা তুমি এত রাগ করছ কেন ?
~ না রাগ করার কি আছে , আর তুই আমার কে যে তোর কথায় আমি রাগ করব !
মেয়েটা চুপ করে যায়।
রাত বাড়তে থাকে। অমল ধীরে ধীরে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে।
********************************************************************************
দিন যায়। কখনও সখনও রাতের বেলা মেয়েটির সাথে কথা হয়, কখনও শুধু চোখে চোখ পড়ে।
মাঝে মধ্যে একটু রাতে মেয়েটি যখন বাইরে এসে বসে, অমলও ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসে। এই রকমই একদিন ক্লান্ত শরীরে মেয়েটি বসেছিল চুপ করে। অমলেরও থলি প্রায় খালি হয়ে এসেছে। পায়ে পায়ে মেয়েটির পাশে এসে বসে অমল।হঠাত্ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখে ওর ডাগর চোখ দুটি জলে ভরা। অমল বলে -
~ এই পাখি তুই কাঁদছিস ?
~ কই ? কাঁদছি নাতো।
~ মিছে কথা কেন বলছিস ?
~ না আসলে আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, তাই।
~ আচ্ছা পাখি তুই এখানে এলি কি করে ?
~ আমি আসিনি, আমাকে জোড় করে এখানে নিয়ে এসেছে।
~ কেন?
~ বাবা মারা যাওয়ার পর সত্ মা বিয়ের নাম করে দালালের হাতে আমাকে বেচে দিল। তারপর সেই লোকটা কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরিয়ে এখানে এনে পাকাপাকি ভাবে খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়।
জান অমল প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, খুব কান্না পেত। এখন আর চোখে জল আসেনা। শুধু আমার মার কথা মনে পড়লে মনটা কেঁদে ওঠে।
~ তুই পালাতে পারিসনা পাখি ?
~ পালাবো ? এখান থেকে ? জানোনা এখান থেকে পালানো যায় না, আর পালিয়ে যাব কোথায় ! আমার তো কেউ নেই।
~ তোর খুব কষ্ট তাই না রে ?
~ আমার কষ্টতো তোমার কি ? আমি তোমার কে ?
~ না, কেউ না।
অমল উঠে পড়ে, যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায়। হঠাত্ নিচু হয়ে মেয়েটির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে - তুই আমার রাতপাখি।
বলেই হনহন করে হাঁটা লাগায়।
অবাক চোখে চেয়ে থাকে পাখি।
**********************************************************************************
পরদিন বড়চালায় লোকের আনাগোনা একটু বেশীই ছিল। অমলের ব্যাস্ততাও বেড়ে যায়।
তবে কাজের ফাঁকে তার চোখ রাতপাখিকে খুঁজে বেড়ায়।
রাত তখন বেশ গভীর, অমল ঘরের পথে পা বাড়ায়। হঠাত্ কেউ ওকে ডাকে - এই পাউচওয়ালা।
অমল ঘুরে তাকায়। দেখে তার রাতপাখি দাঁড়িয়ে।
~ আমার একটা নাম আছে জানিসনা !
~ তা আছে। কিন্তু সবাইতো তোমায় পাউচওয়ালা বলেই ডাকে।
~ তা বলে তুইও ডাকবি !
~ কেন ? আমি ডাকলে কি হবে ? আমি তোমার কে ?
অমল চুপকরে থাকে।
~ কি হলো বললেনা তো ?
~ রাতপাখি।
~ কেন ? আমি রাতপাখি কেন ?
~ বা রে তোকেতো শুধু রাতেই দেখি তাই।
দুজনেই চুপচাপ।
~ তুই রাগ করলি পাখি ? আচ্ছা , আয় এখানে এসে বোস।
দুজনে চুপচাপ বসে থাকে পাশাপাশি। হঠাত্ মেয়েটি বলল -
~ আমাকে এই নরক থেকে নিয়ে যাবে অমল ?
~ তুই যাবি আমার সাথে !
~ সাধতো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু আমি জানি তা সম্ভব নয়।
~ কেন ? সম্ভব নয় কেন ?
~ না কিছু না, অনেক রাত হল যাও তুমি বাড়ি যাও।
মেয়েটি চলে যায়। অমল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।
**************************************************************************************************
কয়েকদিন পরের কথা, সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আকাশের মুখ ভার। চারিদিক থমথম করছে। বড়চালাতেও লোকের আনাগোনা কম, প্রায় নেই বললেই চলে।
অমল অভ্যেস মতো রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজ তার বাজার মন্দা। হঠাত্ ঝড় উঠল তার সাথে বৃষ্টি। সে দৌড়ে একটা খুপরীর চালের নিচে আশ্রয় নিল। মাথাটা বাঁচল, কিন্তু জামা-প্যান্টে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছিল। হঠাত্ খুপরীর দরজাটা খুলেগেল। কেউ একজন বলে উঠল - ভিতরে এসে বসো নাহলে ভিজে যাবে।
অমল তাকিয়ে দেখল পাখি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সে পাখির খুপরীর চালের নিচেই আশ্রয় নিয়েছে।
~ কি হলো ! এসো !
~ না ঠিক আছে।
~ কেন আমার ঘরে আসতে ঘেন্না হচ্ছে বুঝি ?
~ না তা কেন ! আচ্ছা চল।
~ বসো ।
অগত্যা অমল খাটের উপরই বসল। মেয়েটিও তার পাশে বসে পড়ল।
কিছুক্ষন পর অমল বলল -
~ আচ্ছা পাখি, তুই সেদিন আমার সাথে এখান থেকে যাওয়ার কথা বললি, সত্যি যাবি তুই আমার সাথে!
পাখি চুপ করে রইল।
~ কি হল বল।
~ তা হয়না অমল।
~ কেন হয় না পাখি ! কেন ?
~ আমি যে অপবিত্র, অসতী, কেমন করে আমি এ জীবন থেকে মুক্তি পাব ! হয়না এ হয়না অমল।
~ তুই যে আমার রাতপাখি। জানিস আমার মা বলতো কেউ ইচ্ছা করে খারাপ হয়না, খারাপ হয় তার কপালের দোষে আর পেটের টানে।
~ কিন্তু অমল তোমার রাতপাখির জীবনে এই রাতটাই যে ভয়ঙ্কর সত্যি।
অমল খুপরীর জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। জানলা দিয়ে এক ফালি আকাশের তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল -
~ পাখি তুই রাতের আকাশের তারা দেখেছিস ? তারা কিন্তু রাতেই দেখা যায়।
পাখি পায়ে পায়ে এসে অমলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
~ ওই দেখ পাখি ওইযে তারাটা ওটা অরুন্ধুতী, আর ওইটা ওটা রোহীনি। জানিস , এরা সবাই কিন্তু পবিত্র সবাই সতী কিন্তু রাতে ছাড়া এদের দেখা পাবি না।
~ কিন্তু অমল
~ কোন কিন্তু না, তুই যে আমার রাতপাখি।
~ আমার বড় ভয় করছে যদি কেউ জানতে পারে তাহলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।
~ আমার উপর ভরসা রাখ। কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু হতে দেব না।
অমলের কাঁধে মাথা রাখে পাখি। দুজনের স্বপ্ন মিলেমিশে এক হয়ে যেতে থাকে, রাত গভীর হয়।
****************************************************************************************************
পাখি জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এল, অমলতো এখনও ফিরে এল না, এত দেরী কেন হচ্ছে কেন ?
তারপরই সে অমলকে দেখতে পায়, ক্লান্ত শরীরে ধীর পায়ে বাড়ীর দিকেই আসছে।
~ কি গো এত দেরী হল ?
~ আজ কাজ একটু বেশী ছিল, মালিক বলল আজকের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে তাই দেরী হয়েগেল।
না অমল এখন আর পাউচ বিক্রি করে না। বস্তি ছেড়ে অন্য শহরে এসে বাসা বেঁধেছে তার রাতপাখির সাথে।
অন্ধকার জীবনটাকে ছেড়ে আসা এত সহজ ছিল না। কিন্তু ওই সমিতির দিদিদের কল্যানে আজ দুজনে স্বপ্ন দেখে।
যে স্বপ্ন অমল একদিন ফেলে এসেছিল বইয়ের পাতায়, আজ সেই স্বপ্ন কুড়িয়ে মালা গাঁথে তার রাতপাখিকে সাজাবে বলে।
পাখি অমলের বুকে মাথা রেখে খোলা জানলা দিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চাঁদের রাত পরিক্রমার শেষে সূর্যের আগমনের প্রস্তুতি।
অমলের রাতপাখি আলোর পাখি হয়ে বুকে এসে ধরা দেয়।
****** সমাপ্ত ******
কোন মন্তব্যই যথেষ্ট নয় এই গল্পের জন্যে। একটা অদ্ভুত আশা খেলাকরেছে প্রতিটা লাইনে। পড়ছি, অমলের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে অমল। দাঁড়াবেই। কুর্নিশ। অদ্ভুত সুন্দর লেখা।
উত্তরমুছুনদারুন হয়েছে। বেশ অন্যরকম।
উত্তরমুছুনদারুন হয়েছে। বেশ অন্যরকম।
উত্তরমুছুনকখন পড়া শেষ হয়ে গেছিল খেয়াল করিনি। এখনো রেশ লেগে আছে, মনে হয় থাকবেও।
উত্তরমুছুনআর, একটা কথা বলতে পারি, যখনই জীবনের কঠিন সময়গুলো আসবে, আর তখন দুরের আলোগুলোর দিকে তাকাবো, এই লেখাটা মনে পড়বে।
ধন্যবাদ নীলাঞ্জন .... তোমার মনের এই রেশটুকুই আমার বড় পাওনা ।
উত্তরমুছুনসোমনাথ তোর ভালোলেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগছে ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ Dear .... গতানুগতিক থেকে একটু দূরে একটু অন্যরকমই লেখার চেষ্টা করলাম
উত্তরমুছুনআবেশময় ভাষায় অমল আলো ছড়ানো এই লেখায়। অনবদ্য।
উত্তরমুছুন