ভদ্রাবতী কথা

সে অনেকদিন আগের কথা, তখন এই বঙ্গে অনেক রাজা রাজত্ব করতো। এমনই এক রাজা ছিলেন পুরুলিয়ার কাশিপুর অঞ্চলের পঞ্চকোট রাজপরিবারের মহারাজ নীলমণি সিং দেও। এই রাজার রাজ্যে এক ছোট্ট গ্রামে বাস করতো ছোট্ট এক মেয়ে। তার নাম ছিল ভদ্রাবতী। রূপে গুণে সে ছিল যেন সাক্ষাত দেবী লক্ষী। রাজা নীলমণি লোক মুখে সে খবর পেয়ে  একদিন হাজির হলেন সেই গ্রামে। ছোট্ট ভদ্রাবতীকে দেখে রাজা অভিভূত হয়ে গেলেন। এ যেন সত্যি সত্যি সাক্ষাত দেবী লক্ষী।
রাজা মনে মনে ভদ্রাবতীকে নিজের মেয়ে বলে মেনে নিলেন। ভদ্রাবতীর পিতাকে ডেকে বললেন ভদ্রাবতীকে তিনি নিজের রাজপ্রাসাদে নিয়েগিয়ে রাখবেন। আজ থেকে ভদ্রাবতীর সমস্ত দায়িত্ব রাজার। কিন্তু পিতা তাঁর নিজের মেয়েকে কাছ ছাড়া করতে চাইলেন না। তার মেয়ে অন্ত প্রাণ, কি করে সে মেয়েকে ছেড়ে থাকবে  !
রাজা বললেন ঠিক আছে মেয়ে তোমার কাছেই থাক কিন্তু আজ থেকে তার ভালমন্দ সবকিছুর দায়িত্ব আমার।
ছোট্ট ভদ্রাবতীর হেসে খেলে দিন যায়। ধীরে ধীরে তার দেহে ও মনে আসে যৌবনের ছোঁয়া। তাদের পাশের গ্রামের অঞ্জন নামে এক যুবকের সাথে গড়ে উঠল তার প্রেমের সম্পর্ক। দুজনে দুজনকে চোখে হারায়। ভদ্রাবতী গান গায় , অঞ্জন সেই গানের সুরে বাঁশি বাজায়।
ভদ্রাবতীর জন্মদাতা  পিতার তাদের এই সম্পর্কে কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাধ সাধলেন রাজা নীলমণি সিং দেও। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মানস কন্যাকে উচ্চ বংশীয় কোন পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে। অঞ্জনকে বন্দী করে আটক করে রাখলেন অজানা জায়গায়।
মনের দুঃখে ভদ্রাবতী তার দুই সখিকে নিয়ে সারা রাজ্যে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। সারাদিন সারারাত গান গেয়ে খুঁজে বেড়ায় তার প্রাণাধিক অঞ্জনকে। যদি তার গান শুনে একবার সে ছুটে আসে। কিন্তু হায়! অঞ্জন আর আসে না। রাজা নিরুপায় হয়ে যখন অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন তখন ভদ্রাবতী আর নেই। শুধু রাজ্যের মানুষের  মনে সে রয়ে গেছে ভাদু হয়ে। আর তার গান লোকমুখে হয়ে গেছে ভাদু-গান।
স্থান বিশেষে আরও একটি লোকগাথা শোনা যায়। রাজা নীলমণি সিং দেও-এর তৃতীয়া কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী। বিয়ে করতে আসার পথে ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও বরযাত্রীরা ডাকাত দলের কবলে পড়ে ও নিহত হয়। লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার ভয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজকুমারী ভদ্রাবতী।
আবার বীরভূমের প্রচলিত লোক গাথা হল ভদ্রাবতী হেতমপুরের রাজকন্যা। বর্ধমানের রাজপুত্রের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে করতে আসার পথে ইলামবাজারের কাছে অবস্থিত চৌপারির শালবনে ডাকাতের আক্রমণে রাজপুত্রের মৃত্যু হলে ভদ্রাবতী রাজপুত্রের চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন।
কেউ কেউ বলেন তার নাম ভদ্রাবতী নয় ভদ্রেশ্বরী।
কাহিনী যাই হোক, ভদ্রাবতীকে মানুষের মনে চিরস্মরনীয় করে রাখার জন্য রাজা নীলমণি সিং দেও তাঁর রাজ্যে ভাদু পুজা ও ভাদু-গানের প্রচলন করেন।
পঞ্চকোট রাজপরিবারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ দরবারে হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ,তবলা, সানাই সহযোগে মার্গ ধর্মী উচ্চ সাহিত্য গুন নির্ভর ভাদু গান গাওয়া হত। এই পরিবারের ধ্রুবেশ্বর লাল, প্রকৃতীশ্বর লাল ও রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং দেও 'দরবারী ভাদু' নামক ঘরানার সৃষ্টিকর্তা।
তবে মানুষের মুখে মুখে ফেরা ভাদু-গান, লোকসঙ্গীত হিসাবেই বেশী জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গৃহনারীদের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী এই গান গুলির প্রাধান উপজীব্য। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতীর চিত্র সরস ভঙ্গীতে প্রকাশ করা হয়।
পূর্বে ভাদুর কোন মূর্তি ছিল না। একটি পাত্রে ফুল বা গোবর রেখে তার উপর ধান ছড়িয়ে ভাদুর রূপ কল্পনা করা হত। পরবর্তী কালে ধীরে ধীরে মূর্তির প্রচলন ঘটে। সাধারণত ভাদু মুর্তি, হাঁস বা ময়ূর বা পদ্মের উপর উপবিষ্টা। গায়ের বর্ণ হলুদ। আবার কোথাও কোথাও হালকা গোলাপী বর্ণও হয়ে থাকে। মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুল, গলায় পদ্মফুলের মালা ও হাতের তালুতে আলপনা থাকে। কখনও মূর্তির কোলে কৃষ্ণ মূর্তিও থাকে।
        
ভাদ্র মাসের প্রথমদিনে কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোন একটি বাড়ির কুলুঙ্গী পরিষ্কার করে তাতে একটি পাত্রে ফুল বা গোবরের উপর ধান ছড়িয়ে ভাদু প্রতিষ্ঠা করে ও ভাদু-গান গায়। ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদু মূর্তি ঘরে আনা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে ভাদু জাগরণ পালন করা হয়। এই রাতে রঙীন কাগজ বা কাপড়ের তৈরী ঘরে ভাদু মূর্তি স্থাপন কুরা হয়। সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয় নানা রকমের মিষ্টি। এরপর রাত নটা বা দশটা থেকে গাওয়া হয় ভাদু-গান বা ভাদু গীতি। চলে রাত ভোর পর্যন্ত। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে মেয়েরা দল বেঁধে ভাদু-গান গাইতে গাইতে ভাদু মূর্তি বিসর্জন করে।

এই ভাদু উৎসব মূলত পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম এবং ঝাড়খন্ডের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব।
সাধারণত এই সব অঞ্চলে ভাদ্র মাসে আউশ ধান ওঠে। সারা বছর হাড় ভাঙা খাটুনির পর এই সময় টুকু একটু অবসর। একটু অনাবিল আনন্দ। এই সময়টুকু গ্রামের মহিলারা নিজেদের মত করে কাটায়। এই উৎসবের দিন নিজেদেরকে একটু সময় দেবার দিন। তাইতো ভাদু গানে বলে -
ভাদু পুজার দিনে,
সারা রাত উড়াব ফুর্তি হে,
কাটাব জাগরণে।
বাকী আজ রাইখনা কিছু
যা ইচ্ছা মনে,
রাখ, লোক-লজ্জা,
দাও দরজা,
মহাপুজা এইখানে।

এইসব গানে বর্তমান সময়ের কথা, জীবনের কথাও সহজেই উঠে আসে।
এই উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে জিলিপি তৈরীর রেওয়াজ। ভাদু মা কে খুশি করতে তৈরী হয় বিশাল আকারের জিলিপি। জিলিপির আকার ছোট হলে পাছে ভাদু মায়ের মুখ ভার হয়।

অবাক দেখে শুনে,
কেঞ্জাকুরার অশোক দত্তের দোকানে,
বড় বড় জিলিপি গুলান,
সোয়া কেজি ওজনের।

স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, ভাদু মা লক্ষীর আর এক রূপ।  ভাদুর পরিচয় নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক না কেন, রাঢ় বাংলার ঘরে ভাদু কোন দেবী হিসাবে নয়, ঘরের মেয়ে হিসাবেই স্থান পেয়ে থাকে।
তাইতো মেয়েরা সহজেই গেয়ে ওঠে -
আমার ভাদু সোনার জাদু,
কে পঠাইলে কোলকেতা,
সেই কোলকেতারই লুনা জলে,
ভাদু হইল শ্যামলতা .........


(ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগ্রীহিত)

মন্তব্যসমূহ

  1. ভাদুর এই ইতিহাস জানতাম না তো। আমরা ইয়োরোপ কি জাপানের ইতিহাস নিয়ে কত রকম ঘাঁটাঘাঁটি করি, অথচ নিজেদের ইতিহাস নিয়েই নিরাশক্ত। খুব ভাল লাগল ভদ্রাবতীর কথা। অনেক কিছু জানলাম অথচ তথ্যে ভারাক্রান্ত হতে হলো না। সত্যি বলতে কি ভাদু নিয়ে আমার তেমন কোন ধারনাই ছিল না। এখন হলো, এবং বিষয়টা নিয়ে খুব উৎসাহীও হয়ে পড়লাম। লেখকের অন্যতম কর্তব্য তো এটাই, বিষয়ের ওপরে কৌতুহল সৃষ্টি করা। খুব ভাল লেখা। দারুন লাগল।

    উত্তরমুছুন
  2. একমনে পড়ে ফেললাম। একদম সহজভাবে বলা গ্রামবাংলার কিছু দারুণ কথা, যেটা আমার কাছে অজানা ছিল। ব্যাপার হল, এটা পড়ে আমার কিছু কৌতূহল জেগে উঠল, আর তার জন্যেই একটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য তোমার। দারুণ লিখেছ ��

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস