আগমনী

ছোটবেলায় বাংলার মাস তারিখ বা ঋতু কোনটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না এখন বুঝলেও হয়তো মনে রাখার তাগিদ অনুভব করিনা কিন্তু আমাদের বাংলার এই প্রকৃতি শর ঋতুটিকে ভুলতে দেয় না তার একটা কারণ আকাশের গায়ে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আর বাংলার কোল জুড়ে কাশফুলের বাহার আর একটা কারণ অবশ্যই দুর্গোসব ছোটবেলায় যেমন কাশফুল ফুটলেই বুঝতাম পুজো এসে গেছে, এখনও তার অন্যথা হয়না এখন আমাদের চারপাশে বিনোদনের হরেকরকম সমাহার কিন্তু ছোটবেলায় বিনোদন বলতে ছিল পাড়ায় পাড়ায় যাত্রা আর বাউল গান আর ছিল রেডিও ঠিক পুজোর আগে আগে রেডিওতে শোনা যেত আগমনী গান তখন আগমনী গানের মানে না বুঝলেও শুনতে ভালোলাগত মাঝে মধ্যে মা গল্প বলত শিব-দূর্গা আর তার ছেলে মেয়েদের যত বড় হতে থাকলাম তত আগমনী গানের মানে অনুধাবন করতে থাকলাম এই বাংলায় বহু কাল ধরে চলে আসছে এই আগমনী গান পুজোর আগে চারণকবিরা সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে গেয়ে ফিরতেন এই আগমনী গান আমাদের সময়ে এই কবিরা তখন বিলুপ্ত প্রায় 
আগমনী গানের প্রেক্ষাপট আমাদের বঙ্গজীবনের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে মিলেমিশে একহয়ে গেছে 
প্রাচীন পুরাণে শিব-দূর্গার আখ্যান সম্বন্ধে যাই থাকনা কেন আমাদের বাংলার লৌকিক দেবদেবীদের নিয়ে বেশ কিছু উপাখ্যান আছে তার মধ্যে শিব-দূর্গার এই উপাখ্যান অন্যতম আর এই শিব-দূর্গার উপাখ্যানকে সামনে রেখে এই বাংলায় রচিত হল আগমনী গান প্রচলিত কাহিনীর দিকে একটু তাকানো যাক বড়লোক বাবা গিরিরাজের মেয়ে উমার (দূর্গা/পার্বতী), শ্মশান বাসি শিবের সাথে বিয়ে হয়েছে বিয়ের পরে উমা স্বামী ঘরে চলেগেলে মেয়ের দারিদ্রে ভরা জীবনের কথা ভেবে মা মেনকার মন আকুল হয়ে ওঠে 
এই শরতের কোন এক রাতে উমাকে স্বপ্নে দেখে মা মেনকা গিরিরাজকে বলেন উমাকে কয়েকদিনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসতে অবশেষে মা-বাবার অনুরোধে উমা দিন চারেকের জন্য বাপের বাড়ি আসতে সম্মত হয় উমার এই বাপের বাড়ি আগমনকে কেন্দ্র করেই রচিত হয় আগমনী গান 
এই উপাখ্যানে উমা ভক্তের কাছে জননী নন, উমা এখানে কন্যাসমা উমার আগমনে যেমন বেজে ওঠে আগমনী সুর তেমনি উমার বিদায়ের মুহুর্তে বাজে বিজয়ার করুন সুর উমার আগমন প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে আগমনী বিজয়ার গানের সৃষ্টি এই সব গানগুলোকে একত্রে বলাহয় আগমনী-বিজয়ার গান এই গানের প্রথম শ্রেষ্ঠ রচয়িতা রামপ্রসাদ সেন ( আনুমানিক 1720 - 1781 ) এরপর আরো যাঁরা এই আগমনী গানকে সমৃদ্ধ করছেন তাঁদের মধ্যে রাম বসু, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য দাশরথি রায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব 
মনে করা হয় আগমনী-বিজয়া গানের অনুপ্রেরণা এসেছে বৈষ্ণব গীতিকাব্য থেকে মঙ্গলকাব্যের রুদ্রচন্ডি একধারে কন্যা মাতৃ রূপে আগমনী গানে আবির্ভূত হয়েছেন গান গুলিতে বাৎসল্য করুন রসের অপূর্ব সমাহার দেখা যায় গান গুলিতে ততকালীন বঙ্গ হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে তাদের গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা এই গানের মাধ্যমে ব্যাক্ত করা হয়েছে শুধু তাই নয় মেয়ে তার শ্বশুর বাড়ির মধ্যে বিরোধের কথাও এই গান গুলিতে দেখতে পাওয়া যায় 
সেইসময় সমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল মা মেনকার মতো আমাদের সমাজের মায়েরাও শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের সুখ-দুঃখের কথা ভেবে আকুল হয়ে পড়তেন বাড়ির বিবাহিত মেয়েরা সাধারণত এই দূর্গোৎসবের সময় বাপের বাড়ি যাওয়ার ছাড়পত্র পেত এই সময় মেয়েকে কাছে পেয়ে মা যেমন আনন্দিত হতেন আবার বিদায়ের সময় মেনকার মতো দুঃখে কাতর হয়ে পড়তেন মেয়েকে ছাড়তে মন চাইতো না তইতো মেনকা গিরিরীজকে বলছেন - 
গিরি, এবার আমার উমা এলে 
আর উমা পাঠাবো না 
বলে বলবে লোকে মন্দ 
কারো কথা শুনব না 
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়, 
উমা নেবার কথা কয় - 
এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া 
জামাই বলে মানবো না 
দ্বিজ রামপ্রসাদ কয়, 
দুঃখ কি প্রাণে সয়, 
শিব শ্মশানে-মশানে ফিরে, 
ঘরের কথা ভাবে না 
কিন্তু বাংলা গানের এই ধারা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি হয়তো সমাজ ব্যবস্থার পট পরিবর্তনের কারণে, মা কে কন্যারূপে কল্পনা করে ভক্তিরসের যে ঢেউ বঙ্গজীবনে এসেছিল তা কালের নিয়মে স্থিমিত হয়ে যায় তাই এগানের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায় 
তবুও আমাদের বাংলায় আজও উমা শিবকে মেয়ে জামাই রূপে কল্পনা করে পুজোর এই কদিন আমরা উমার বাপের বাড়ির লোকজন আনন্দে মেতে উঠি 
তাইতো মেনকার সাথে সাথে আমরাও গেয়ে উঠি - 
গিরি, গণেশ আমার শুভকরী 
নিলে তার নাম, পূর্ণ মনস্কাম, 
সে আইলে - গৃহে আসেন শঙ্করী 
বিল্ববৃক্ষ-মূলে করিব বোধন, 
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন 
ঘরে এলে চন্ডী,শুনবো আমরা চন্ডী, 
আসবে কত দন্ডী,যোগী,জটাধারী 

********* সমাপ্ত *********

মন্তব্যসমূহ

  1. আরেব্বাস রে। অনেক কাল বাদে আগমনী গান নিয়ে চর্চা। আজকাল এসব তো ভুলতে বসেছে লোকে। আর আরো ভাল লাগল, গানের মধ্যে দিয়ে আর্থসামাজিক প্রেক্ষ্যাপট উঠে এসেছে। শিল্পের প্রেক্ষ্যাপট না জানলে, তাকে ঠিক ঠাক উপভোগ করা যায় না। এবার পূজোয় এই লেখাটা উপরি পাওয়া। লেখার পেছনের পরিশ্রম কে কুর্নিশ।

    উত্তরমুছুন
  2. পূজোর ঠিক আগে এমন পূজার গন্ধ মাখা একটা লেখা দারুন লাগলো আর সেই সাথে আগমনী গানের মত একটি রস সমৃদ্ধ প্রায় বিলুপ্ত শিল্প নিয়ে চর্চা সত্যি উপভোগ্য।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

দুঃখ বিলাস