চেনা পুরী অচেনা ভ্রমণ




সমুদ্রের প্রতি আমার একটা অমোঘ আকর্ষন আছে সেটা অস্বীকার করতে পারি না। আর বাঙালীর কাছে সস্তার সমুদ্র ভ্রমনের জায়গা হল পুরী। অনেকে এই পর্যন্ত পড়েই রে রে করে উঠবেন যে বাঙালী পুরী যায় তীর্থ করতে। সমুদ্র ভ্রমন কেন হবে। সেটা হয়তো অনেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু আমার মতো কতিপয় মানুষ আছেন যাদের কাছে পুরী মানেই সমুদ্র। আমার কাছে সন্ধ্যেবেলা বৌ-মেয়েকে পাশে নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে থাকার আনন্দটাই আলাদা রকম।

এর আগেও বহুবার পুরী গিয়েছি তাই এবারে পুরী যাওয়ার কথা উঠতেই বৌ বলল একই জায়গায় কতবার যাবে!  মেয়ে বলল যেতে পারি তবে সমুদ্র ছাড়া আর কোথাও যাব না। কিন্তু সারাদিন সমুদ্রের ধারে কি করব সেটাও একটা সমস্যা। পুরীর আশেপাশে যে দর্শনীয় স্থান গুলি আছে তা আগে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েগেছে। তাই এবার ভাবলাম যে পুরীর আশেপাশে এমন কোন জায়গায় যাব যেখানে আগে কখনো যাই নি। তাই মেয়েকে বললাম চল এবার নতুন ভাবে পুরী দেখব।
দূর্গাপুর থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে র ওনা দিলাম পুরীর পথে।পরদিন সকালবেলা পুরী স্টেশন পৌঁছে অটো ধরে চললাম স্বর্গদ্বারের দিকে। অটো যখন নিউ মেরিন ড্রাইভ রোডে উঠল তখন সমুদ্রের গর্জন আর হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
স্বর্গদ্বার থেকে যে রাস্তাটা শশ্মানের পাশ দিয়ে কাকাতুয়া খাজার দোকানের দিকে গেছে , সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগলেই রাস্তার পাশে একটা সস্তা অথচ বেশ ভাল একটা হলিডে হোম আছে।  আমরা উঠলাম সেখানেই। রুমে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে মেয়ের তাগাদা শুরু হয়েগেল কখন সমুদ্রের ধারে যাওয়া হবে সেই নিয়ে।
যারা সমুদ্রের টানে পুরী গেছেন তাদের কাছে সমুদ্রের রূপ বর্ণনা আর নাই বা করলাম। আসলে এই পুরী ভ্রমন নিয়ে হাজার হাজার পাতা লেখা হয়েগেছে। আর এই একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান অনেকের বিরক্তিকর লাগতে পারে।
রাতের ট্রেন জার্নিতে আমার ঠিক মত ঘুম হয় না। তাই দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় একটু গড়াতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানিনা। বৌ আর মেয়ের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির কাঁটা ৬টার ঘরে। সমুদ্রের ধারে যখন এলাম তখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেছে। যে যাই বলুক রাতের সমুদ্রের কিন্তু আলাদা একটা রূপ আছে। সমুদ্রকে পাশে রেখে খুঁজতে বেড়লাম ট্রাভেলার্সের আফিস। ওমা  খুঁজব কি  এখনতো দেখি সারি সারি ট্রাভেলার্সের গুমটি রাস্তার ধারে। যাই হোক তাদের কে গিয়ে যখন আমার পরেরদিনের গন্তব্যের কথা বললাম তারা একটু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে র ইল। বলল না দাদা আমরা ঠিক ওই জায়গাটা চিন্তে পারছিনা। অগত্যা চললাম অন্য ট্রাভেলার্সের কাছে। বেশ কয়েকটি ট্রাভালার্স ঘুরে অবশেষে একজন বলল আমিতো বুঝতে পারছি না তবে আমাদের এক ড্রাইভার হয়তো জানে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন আমি কথা বলিয়ে দিচ্ছি। ড্রাইভার সাহেব এলেন,  বললাম আমার গন্তব্যের কথা। ঠিক হল পরদিন সকাল ৮ টার সময় রওনা দেব।
পরদিন সকালে সময় মতো রওনা হলাম চেনা পথে অচেনাকে জানার জন্য। প্রথমে চেনা পথে পেলাম চন্দ্রভাগা সি বিচ। চারিদিক রঙীন কাগজে কাপড়ে সাজানো। একটু অবাক হলাম। জানলাম আমরা নিজেদের অজান্তে স্যান্ড ফেস্টিভেলের দিন এসে পড়েছি। দেশবিদেশের বহু প্রতিযোগী এসেছে এই ফেস্টিভেলে অংশ গ্রহনের জন্য। চলেছে তাদের শিল্পকর্মের প্রস্তুতি। হাতে সময় কম তাই চাক্ষুস করার ইচ্ছা ত্যাগ করে চললাম পরবর্তী গন্তব্য কোনারক। হয়তো অনেকেই বলবেন এ আর নতুন কি এতো সবাই যায়। কিন্তু আমার গন্তব্য ঠিক কোনারক মন্দির নয়,  আমার গন্তব্য কোনারক মিউজিয়াম। বেশীর ভাগ পর্যটক মন্দির দেখেই ফিরে যায়।  তা্দের মধ্যে অনেকেই আবার এই মিউজিয়াম সম্বন্ধে ওয়াকিবহল নয়। আবার অনেকে বলেন ধুর ওখানে দেখার আর কি আছে। যাই হোক আসলে এই মিউজিয়ামে  কোনারক মন্দির থেকে খসে পড়া শিল্পকর্ম গুলি ঠাঁই পেয়েছে। কোনারক ছাড়াও আরো কয়েকটি মন্দিরের শিল্পকর্ম রয়েছে এখানে। কোনারক মন্দিরের যে সূর্যমূর্তিটি সেই যুগে আরাধনা করা  হতো সেটি এই মিউজিয়ামে রাখা আছে। মিউজিয়ামটি খুব একটা বড় নয় তবে বেশ সুন্দর করে সাজান। মিউজিয়াম থেকে বেড়িয়ে  বাইরে এসে সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে একটু এদিক ওদিক উঁকি মারতেই চোখে পড়ল মিউজিয়ামের পাশের ফাঁকা জায়গায় প্রচুর প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শন খোলা আকাশের নিচে পরে আছে।  এভাবে অবহেলায় পরে থাকার কারন হয়তো মিউজিয়ামে জায়গার অভাব। তবুও মনটা একটু খারাপ হল।মিউজিয়াম থেকে বেড়িয়ে চলে এলাম কোনারক মন্দিরে। মন্দির পরিক্রমা সেরে বেড়িয়ে পড়লাম আমার একদম অপরিচিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার সাহেবের সাথে ততক্ষণে বেশ ভালো ভাব জমে গেছে। ড্রাইভার সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি এই জায়গার হদিশ কি করে পেলাম। কারণ পর্যটকরা এই জায়গাতে কেউ আসে না। দু-এক জন হাতে গোনা পর্যটক ছাড়া কেউ এই পথ মাড়ায় না। বললাম কিছু লেখা পড়ে জেনেছি। আসলে হাবিজাবি যা পাই সব পড়ে ফেলি।তারপর আছে অতি ব্যবহৃত গুগুল সার্চ।  এভাবেই খোঁজ পাই এই জায়গার।
পথে যেতে যেতে গাছগাছালি ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশে একটি হোটেল দেখতে পেয়ে গাড়ি দাঁড়করালাম দুপুরের খাওয়াদাওয়ার জন্য। বাইরে দেখলাম নাম লেখা আছে হোটেল রূপা। তবে হোটেল না বলে এটাকে ধাবা বলাই ভালো। মাথার উপর খড়ের ছাউনি দেওয়া চারিদিক খোলা। চারপাশে প্রচুর গাছপালা। রান্না অত্যন্ত সুস্বাদু। এইরকম জায়গায় এত ভালো খাবার পাব আশা করি নি। খাবারের দাম ও তুলনামুলক কম। খাওয়া শেষে আবার চলা শুরু।
যারা এই লেখাটা পড়ছেন তারা হয়তো এতক্ষণে অস্থির হয়ে পড়েছেন জায়গাটার নাম জানার জন্য। মনে মনে ভাবছেন যে এত ভনিতার কি আছে, সোজাসুজি জায়গাটার নাম বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। জায়গাটার নাম তো অবশ্যই জানাব না হলে তো এই লেখাটাই বৃথা। তার আগে একটা গল্প বলি।
পুরাণ অনুযায়ী কোন এক সময় সারা পৃথিবীর মানুষ অসুরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বাদ যাননি স্বর্গের দেবতারাও। সেই সময় দেবী দূর্গা অবতীর্ন হয়েছিলেন অসুর নিধনে।এই অসুরদের দলপতি ছিল রক্তবীজ। দেবী দূর্গা চন্ডিকা রূপ ধারণ করে রক্তবীজের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। সে ভয়ানক এক যুদ্ধ। কিন্তু সমস্যা হল রক্তবীজের শরীর থেকে যত ফোঁটা রক্ত মাটি স্পর্শ করে তার দ্বিগুন সংখ্যক রক্তবীজের জন্ম হয়। দেবী চন্ডিকা তখন আহ্বাণ করলেন সপ্ত মাতৃকাদের। এঁরা হলেন ব্রাহ্মণী, মহেশ্বরী, কুমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, ইন্দ্রাণী ( ঐন্দ্রী) এবং চামুন্ড। এরা যোগ দিলেন দেবী চন্ডিকার সাথে। এদেরকে একসাথে বলাহয় অষ্ট মাতৃকা। দেবী চন্ডিকা ও সপ্তমাতৃকা,  এদের প্রত্যেকে আবার আট জনের সমন্বয় ।এদের বলাহয় যোগিনী । মোট চৌষষ্টী জন যোগিনী ,দেবী চন্ডিকা ও সপ্ত মাতৃকা অবতীর্ণ হলেন রক্তবীজের সাথে যুদ্ধে। রক্তবীজের শরীরের প্রতি ফোঁটা রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই এই যোগিনীগণ পান করে নিতে লাগলেন। অবশেষে এই অসুরের হাত থেকে নিস্কৃতি পেল জগৎ সংসার।
কারো কারো মতে মহালক্ষীকে নিয়ে মাতৃকার সংখ্যা নয় (৯) । সেই হিসাবে যোগিনীর সংখ্যা একাশি(৮১) । তবে বেশীর ভাগ পন্ডিত যোগিনীর সংখ্যা চৌষষ্টির পক্ষে।প্রত্যেক যোগিনীর আলাদা আলাদা নাম আছে। নাম গুলি একবার দেখে নেওয়া যাক।
১) বহুরূপা   ২) তারা  ৩) নর্মদা  ৪) যমুনা  ৫) শান্তি  ৬) বরুনী  ৭) ক্ষমাঙ্করী  ৮) ঐন্দ্রী  ৯) বরাহী
১০) রণবীরা  ১১) বানরমূখী  ১২) বৈষ্ণবী  ১৩) কালরাত্রি  ১৪) বৈদ্যরূপা  ১৫) চর্চিকা  ১৬) বেতালী
১৭) ছিন্নমস্তিকা  ১৮) বৃষবাহনা  ১৯) জ্বালা-কামীনি  ২০) ঘাতবরা  ২১) করালী  ২৩) সরস্বতী
২৩) বীরূপা  ২৪) কুবেরী  ২৫) ভালুকা  ২৬) নরসিংহী  ২৭) বীরজা  ২৮) বিকটন্না   ২৯) মহালক্ষী  ৩০) কুমারী  ৩১) মহামায়া  ৩২) রতী  ৩৩) করকরী  ৩৪) সর্পশ্যয়া  ৩৫) যক্ষীনি  ৩৬) বিনায়কী ৩৭) বিন্দ্যবালিনী  ৩৮) বীরাকুমারী  ৩৯) মহেশ্বরী  ৪০) অম্বিকা  ৪১) কামিনী  ৪২) ঘাতবরী  ৪৩) স্তুতী
৪৪) কালী  ৪৫) উমা  ৪৬) নারায়ণী  ৪৭) সমুদ্রা  ৪৮) ব্রাহ্মণী  ৪৯) জ্বলামুখী  ৫০) অগ্নিয়ী  ৫১) অদিতি
৫২) চন্দ্রকান্তি  ৫৩) বায়ুবেগা  ৫৪) চামুন্ডা  ৫৫) মুরতী  ৫৬) গঙ্গা  ৫৭) ধুমাবতী  ৫৮) গান্ধারী  ৫৯)সর্বমঙ্গলা  ৬০) অজীতা  ৬১) সূর্যপুত্রী  ৬২) বায়ুবীণা  ৬৩) অঘোরা ৬৪) ভদ্রকালী ।।


খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতক থেকে দাদ্বশ শতকে এই যোগিনী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য এই যোগিনী আরাধনা করা হত। তান্ত্রিক সাধনার একটি অংশ হল যোগিনী উপাসনা।
তান্ত্রিক সাধনার উতপত্তি কিন্তু বৌদ্ধ সাধকদের হাত ধরেই।

খ্রীষ্টিয় নবম শতকে উড়িষ্যার এক অঞ্চলে  ভোম্মাকার বা ভৌম-কার রাজ বংশের রাজত্ব ছিল। সেই রাজবংশের রাণী ছিলেন হীর দেবী। তিনি সেই সময় এই যোগিনী সংস্কৃতিতে প্রভাাববিত হয়ে একটি মন্দির স্থাপন করেন। রাণীর নাম অনুসারে সেই জায়গার নাম হয় হীরাপুর। আর রাণী তৈরী মন্দির  চৌষ্ট্ (চৌষষ্টি) যোগিনী মন্দির নামে খ্যাত হয়।
আমাদের গন্তব্য ছিল এই চৌষ্ট্ বা চৌষষ্টি যোগিনী মন্দির। স্থানীয় ভাবে এটি মহামায়া মন্দির নামেও পরিচিত।
সেই সময়ে যোগিনী সাধনা ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে নেপাল ও ত্বিবতেও ছড়িয়ে পরেছিল। এই সাধনা সেই সময় গোপনে করা হত। যোগিনী সাধনার পদ্ধতি সাধক সাধিকারা নিজেদের মধ্যেই গোপন রাখতেন। সময়ের সাথে সাথে এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়। কালের অন্তরালে চাপা পরে যায় যোগিনী মন্দির গুলি। যে মন্দির গুলি অবশিষ্ট থাকে সেগুলি চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।
উড়িষ্যার এই অঞ্চলটি আদিবাসী অধুষিত। এই যোগিনী মন্দির ঘিরে এই জনজাতির মনে একটা ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা ছিল। তারা সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার পর কেউ আর মন্দিরে প্রবেশ করত না বা বলা ভাল প্রবেশ করার সাহস পেত না। এই মন্দির সম্বন্ধে বাইরের কোন লোকের কাছে ভুলেও মুখ খুলত না। তাদের ধারণা ছিল বাইরের লোক জানতে পারলে তাদের জীবনে যোগিনীদের অভিশাপ নেমে আসবে। তাই বহু শতাব্দী ধরে এই মন্দির থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। এমনকি কোনারক মন্দিরের কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও বৃটিশরা এর খোঁজ পায় নি।
সময়টা ছিল ১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাস। উড়িষ্যার খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ শ্রী কেদারনাথ মহাপাত্র পুরীর বালিয়ান্তা এলাকায় প্রাচীন পুঁথি ও পুরাতাত্ত্বিক নির্দশন সার্ভে করার জন্য আলওয়ার পুর গ্রামে ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন। একদিন গ্রামের চৌকিদারের কাছ থেকে কথায় কথায় জানতে পারলেন এই গ্রাম থেকে দুই মাইল দূরে একটি গ্রামের মধ্যে একটা গোলাকার ঘেরা জসয়গায় অনেক গুলি মূর্তি সারি বদ্ধ ভাবে সাজানো আছে। পরেরদিন সকালেই তিনি ছুটলেন সেই গ্রামে। গিয়ে দেখলেন তিনি যা সন্দেহ করেছিলেন ঠিক তাই। এটি একটি যোগিনী মন্দির। এরপর কেদারনাথ মহাপাত্র ও আই.এন.টি.এ.সি.এইচ এর সহায়তায় শুরুহয় মন্দিরটির সংস্কার।
আপাত দৃষ্টিতে মন্দিরটি বাইরে থেকে দেখলে একটি গোলাকার স্তুপ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। সুবিশাল উচ্চতা ও বৈভব কোনটাই এর নেই। আছে শুধু বৈশিষ্ট পূর্ণ গঠন শৈলী। এটি একমাত্র যোগিনী মন্দির যার মাথার উপর কোন ছাদ নেই (Hypaethral)।


মন্দিরে একটি মাত্র প্রবেশ দ্বার যার দুপাশে দুটি দ্বারপালের মূর্তি। মূর্তি দুটি সম্ভবত যক্ষের মূর্তি। ভিতরের গোলাকার অংশ জুড়ে সারিবদ্ধ ভাবে যোগিনীদের মূর্তিগুলি রয়েছে। একদম মাঝের মূর্তিটি লাল চেলিতে ঢাকা। এটি চন্ডিদেবী বা মহামায়ার মূর্তি। বর্তমানে এই একটি মূর্তিই নিত্ত পূজা হয়।



মন্দিরের একদম মাঝে রয়েছে চারকোন বিশিষ্ট একটি মন্ডপ। এটি চন্ডি মন্ডপ বলে মনে করা হয়। দেখে মনে হয় এই মন্ডপেই হয়তো মূল পূজাপর্ব অনুষ্ঠিত হত অথবা যজ্ঞ সম্পন্ন করা হত।

প্রত্যেকটি যোগিনী মূর্তি আলাদা আলাদা ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান। একমাত্র এই মন্দিরের যোগিনী মূর্তিগুলি প্রত্যেকটি কোন না কোন প্রাণী, পিশাচ বা মানুষের মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। পুরো মন্দিরটি স্থানীয় ভাবে প্রাপ্ত মোটা বেলে পাথরের তৈরী। মন্দিরটির উচ্চতা ২.৪ মিটার (2.4 m) এবং গোলাকৃতি অংশের দৈর্ঘ্য ২৭.৪ মিটার (27.4 m)।




মন্দিরটির প্রবেশদ্বারের সামনে একটি উঁচু বেদী আছে। এই বেদীর উপর থেকে যদি মন্দিরটি দেখা হয় তাহলে মন্দিরের আকৃতির সাথে শিবলিঙ্গের হুবহু সাদৃশ্য দেখা যায়। মন্দিরের ভিতর ঠিক মাঝখানে যে চন্ডিমন্ডপ আছে সেটি এখান থেকে শিবলিঙ্গের মতো মনেহয় আর মন্দিরের গোলাকার অংশটি গৌরীপটের মতো মনেহয়। যেন শিব ও শক্তি এখানে মিলেমিশে একাকার হয়েগেছে। মন্দিরের বাইরের অংশের দেওয়ালে নবমাতৃকার মূর্তি রয়েছে।



মন্দির অঞ্চলে প্রবেশের মুখে রয়েছে গোপীনাথের ছোট্ট একটি মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গন বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো। এই মন্দির অনেক পর্যটকের কাছে এখনো অচেনা। আগেই বলেছি এই মন্দির উচ্চতায় আকারে অন্যান্য মন্দিরের কাছে নগন্য। কিন্তু এই মন্দিরের আকর্ষন এর বিশেষত্যে।

মন্দির দর্শন শেষে আমরা ফিরে চললাম পুরীতে। পুরীতে প্রবেশের ১০ কিলোমিটার আগে শিল্পকলার একটি হেরিটেজ গ্রাম আছে । গ্রামের নাম রঘুরাজপুর। এই সুযোগে ঘুরে এলাম সেখানেও। উড়িষ্যার হস্তশিল্পকলার আঁতুরঘর এই গ্রাম। এখানে এলে যেমন বিভিন্ন হস্তশিল্প কিভাবে তৈরী হচ্ছে সেটা দেখা যায়,  তেমনি এখান থেকে হস্তশিল্প সংগ্রহ ও করা যায়। এখানের প্রসিদ্ধ শিল্প হলো পট চিত্র। কাপড়, কাগজ ও তেঁতুল বীজের আঠা দিয়ে তৈরী পটে সম্পূর্ন প্রাকৃতিক রঙে এই পট আঁকা হয়।



কথিত আছে এই গ্রামের একজন পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রভুর সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। রথযাত্রার সময় জগন্নাথ দেব মাসির বাড়ি যাত্রা করলে মন্দির ফাঁকা পরে থাকে। সেই সময় এই সেবকের হাতে কোন কাজ না থাকায় সময় কাটাবার জন্য তিনি এইধরনের পট আঁকতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে এই পট শিল্পের সম্মান লাভ করে। তবে মজার বিষয় হল এই গ্রামের প্রত্যেক শিল্পীই এই সেবককে নিজের পূর্বপুরুষ বলে দাবী করেন।
ফিরে চললাম চেনা পরিচিত সেই উত্তাল জলরাশির কাছে। অনেক অজানাকে জানলাম, কিছু অচেনাকে চিনলাম। কিন্তু দিনের শেষে মনের মধ্যে জেগে রইল হীরাপুরের যোগিনীরা ।

***************************** সমাপ্ত*************************





মন্তব্যসমূহ

  1. পুরো-পুরী। একদম এটাই মনে হল পড়ে। স্থান মাহাত্য তো আছেই। আছে পৌরানিক চালচিত্তির, আছে বর্ননা। তবে কিনা সব ছাপিয়ে নেহাত সৌখিন শহুরে ট্যুরিস্ট না হয়ে, পাক্কা ভ্রমনকারী হয়েযাওয়াটাই এই লেখার পাওনা। শুধু লেখক নন, পাঠকও। পড়ে শেষ করেই মনে হলো, এর পরের বার পুরী গেলে, এই জায়গায় নিশ্চিত ভাবেই যেতে হবে। এখানেই পূর্নতা পেল ভ্রমন। আর একখানা ভ্রমনের ইচ্ছে জাগিয়ে তুলে। দারুন লেখা। সঙ্গের ছবিও খাশা। তুখোড়।

    উত্তরমুছুন
  2. এই লেখা যে ভ্রমনের ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে পেরেছে এতেই এই লেখার পরিশ্রম সার্থক।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস