ছেলেটা ( আত্মকথা ১)

                                                                                                                                                                 ছেলেটা এই শীতেও ঘেমে গেছে । সকাল থেকে বাড়ী বাড়ী ঘুরে খবরের কাগজ বিলিকরা । সাইকেলটাও মাঝে মধ্যে বেইমানি করে । চোখে মোটা কাঁচের চশমা । বাবা গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন । এই চোখের জন্য পড়াশোনাটাও ঠিক মত হল না । দাদারা বলল এবার নিজের ব্যবস্থা নিজে করলেই ভালো হয় । অগত্যা সাইকেলের পিছনে বোঝা আর সকাল থেকে ছুটে চলা । হয়তো এভাবেই জীবন টা চলে যেত কিন্তু কোন এক শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে শুরু হল ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ শেখা । সেই সময় কাজ শেখার এত প্রতিষ্ঠান ছিল না , মিস্ত্রির সাথে থেকে কাজ শেখাই ছিল দস্তুর। অতএব শুরু হল আর এক লড়াই , সকালে কাগজ তারপর মিস্ত্রির ফাইফরমাস ,কাজের থেকে অকাজই বেশী । নিজের চেষ্টায় ধীরে ধীরে কাজ শিখে  নিল । মন্দ চলছিল না কিন্তু তার মনে হল এটা কোন স্থায়ী সমাধান নয় । অতএব চল শহরে । সময়টা ১৯৬২ কি ১৯৬৩ সাল হবে ,নব নির্মিত শহরে এসে পৌঁছালো ছেলেটি।বড় দাদার এক বন্ধু সন্ধান দিয়েছিল এ শহরের । আশ্রয় মিলল প্রায় পরিচিত এক আত্মীয়ের কাছে । নতুন শহর , দুচোখে নতুন স্বপ্ন , যখন যে কাজ পেত তাই করত ছেলেটি । ভালোই চলছিল কিন্তু বাধ সাধলেন ভাগ্য বিধাতা । বাড়ীতে থাকার জায়গা কম এই অজুহাতে আশ্রয়হীন হতে হলো তাকে। বহু কষ্টে আশ্রয় মিলল বাজারের এক গুমটি দোকানের ( টিন কাঠ দিয়ে তৈরী ) নিচে । ভোরবেলা উঠে ,সারাদিনের রসদ কয়েকখানি রুটি আর উচ্ছে আলুর সবজী ( মনে হয় এটাই তখন সবচেয়ে সস্তা ছিল) তৈরী করে কাজের জায়গায় পৌঁছাত । সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি আর রাতে ফিরে একটু খাবার , কোনদিন শুধু জল , ব্যাস রাতের জন্য এইটুকু উপাচার । নিঝুম রাতে তারা ভরা আকাশটা চোখের আড়ালেই থাকে গুমটির নিচে , শুধু দুচোখে জেগে থাকে স্বপ্নেরা । কিন্তু এভাবে কতদিন চলা যায় ! ছেলেটি ফিরে চলে তার জন্মভিটেতে । মোটা কাঁচের নিচে দুটি চোখে স্বপ্ন গুলো তবু বেঁচে থাকে ।এর বেশ কিছুদিন পরে ১৯৬৭ সালে আবার আসে এই শহরে । এবার আর এই শহর তাকে ফেরায় না , ঠিকাদারের অধীনে মোটামুটি একটা কাজ জুটে যায় । কিছুদিন পর একটা সুযোগ আসে স্থায়ী কাজের , একেবারে রাজ্য সরকারের অধীনস্ত সংস্থায় । এ শহর তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে । এরপর সংসার সমুদ্রে গা ভাসানো । ঘরে এল ছোট্ট একটি ছেলে ।আদর করে ছেলেকে বলত বাবু বাবা । স্ত্রী ছেলে এই নিয়েই কেটে গেল বেশ কিছু বছর । ছেলে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল , বুঝতে শিখল তার বাবার লড়াই । বাবাকে বলত আমি যখন রোজগার করব তখন তোমাকে আর কাজ করতে দেবো না ।বাবার মুখটা এক অদ্ভুত খুশিতে ভরে উঠত,  বলত ধুর - পাগল ছেলে আমার । নিয়ম মেনে কাজের থেকে অবসর নিতে হল । সেদিনের সেই নতুন শহরে আসা ছেলেটি এখন বৃদ্ধ । সেদিনের স্বপ্ন দেখা চোখ দুটি আজ ধুসর । একটি চোখে আর কোন স্বপ্ন দেখা যাবেনা ,কোন স্বপ্নও আর হয়তো বাকী নেই ।স্ত্রী,ছেলে,বৌমা,নাতনী নিয়ে ভরা সংসার । বড় ইচ্ছে ছিল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জন্মভিটেতে ফিরে যাওয়ার , বাধা আসে জন্মভিটের আসেপাশে ঘিরে থাকা কিছু মানুষের কাছ থেকে । যাওয়া হয়না । ছেলেকে বলে, বুঝলি বাবু ওরা যেতে দিল না । ছেলের কাছে এর কোন জবাব থাকে না । এখন সারাদিনের সঙ্গী ওই বোকাবাক্স , ধুসর চোখে শুধু তাকিয়ে থাকা ।অপেক্ষা করে থাকে  বাবু এখনই কাজ থেকে ফিরবে । একটু দেরী হলে অধৈর্য হয়ে ওঠে । বাবু ঘরে ফেরে, তাকিয়ে দেখে ওই চোখ দুটিকে । বাবু সেই শহরের গল্প  বলে মেয়েকে , জানিস এক শহরে একটা ছেলে এসেছিল রুজীরুটির টানে,আর সে কোনদিন জন্মভিটেতে ফিরে যেতে পারেনি ।মেয়ে বলে, কোন শহর বাবা ? বাবু বলে সেই শহর যেটা আমার তোর জন্মভিটে, আমার প্রাণের শহর, আমার শৈশবের শহর দূর্গাপুর । জানিস মা একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে হয় - বাবা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ।...................সহসা ছোট্ট দুটি হাত এসে জড়িয়ে ধরে । 

মন্তব্যসমূহ

  1. প্রথমটা পড়তে পড়তে একটু ভাবছিলাম, এ লেখা কাকে নিয়ে। তার পরে বুঝলাম। কিন্তু মজা হলো যখন শেষ করলাম, তখন দেখি লেখার আবেদন সার্বজনিন হয়ে উঠেছে। যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই আপনজন, সেখানে আপনজন সেখানেই মানুষের সংসার, আর সখানেই তার ঘরবাড়ি। ভালো লেখা। আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস