পেলোরাস জ্যাক দ্যা পে-লেস পাইলট (Pelorus Jack the pay- less pilot )

ইতিহাস মানে সধারণত আমরা রাজ-রাজাদের কাহিনী, কোন দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী বা প্রাচীন সময়ের সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিবরণ-কেই বুঝি কিন্তু এমন অনেক ঘটনা আমাদের সামনে ঘটে যায় যা নিয়ে কিছুদিন আমরা মাতামাতি করি তারপর তা আমাদের বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যায় আজ যে ঘটনার কথা বলব  তা একদিকে যেমন ঐতিহাসিক অপর দিকে ঠিক তেমনই রূপকথার মতো 
সময়টা আজ থেকে প্রায় 144 বছর আগে 1871সাল ( সাল নিয়ে মতভেদ আছে - সরকারী নথি অনুযায়ী 1888 সাল) , বিভিন্ন মাল যন্ত্রপাতি বোঝাই করে বোস্টন থেকে সিডনি যাচ্ছে এক জাহাজ জাহাজের নাম ব্রিণ্ডল (Brindle) সেদিন সকাল থেকে আকাশ মুখ গোমরা করে আছে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রে ঝড়ের লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছে জাহাজ ঢুকে পরেছে দুঃস্বপ্নের সেই ফ্রেঞ্চ-পাস- ভয়াবহ ফ্রেঞ্চ-পাস যার নাম শুনলেই জাহাজের যাত্রী থেকে শুরু করে মায় ক্যাপ্টেন পর্যন্ত সবার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় বুকের ভিতরটা এক অজানা আশঙ্কায় বার বার কেঁপে ওঠে শান্ত আকাশ আর শান্ত সমুদ্রেও এই ফ্রেঞ্চ-পাস- কত যে জাহাজ ডুবেছে, কত প্রাণ যে গেছে তার কোন হিসাব নেই ফ্রেঞ্চ-পাস শুরু হয়েছে পোলার সাউণ্ড থেকে আর শেষ হয়েছে টাসমান-বে তে এসে এই সুদীর্ঘ জল পথে জলের নিচে লুকিয়ে আছে ডুবো পাহাড় জলের স্রোতে কখন কোন জাহাজ ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ধ্বংস হয়ে যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই তার ওপর এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ফ্রেঞ্চ-পাস থেকে প্রাণে বেঁচে অক্ষত জাহাজ নিয়ে ফিরে আসা ভাগ্যের ব্যাপার, আশ্চর্যজনকও বটে
জাহাজ এগিয়ে চলেছে জাহাজে সবার মুখে বিষন্নতার ছাপ ক্যাপ্টেন বিষন্ন,চিন্তিত মুখে দাঁড়য়ে আছেন পাশে রয়েছন তাঁর সহধর্মিনী এমন সময় নাবিকরা দেখল যে জাহাজের সামনে হঠা একটা বিশাল শুশুক (Dolphin) লাফিয়ে উঠল নাবিকরা প্রথমে তিমির বাচ্ছা ভেবে ভুল করেছিল কিন্তু পর মুর্হুতেই দেখল যে গাঢ় নীল রঙের এক শুশুক জাহাজের আগে আগে চলেছে মাঝে মধ্যে ফুর্তিতে ডিগবাজীও খাচ্ছে, যেন পুরানো কেন বন্ধুর দেখা পেয়েছে সে নাবিকরা কেউ কেউ তাকে হারপূন দিয়ে শিকার করে জাহাজে তুলতে চাইল কিন্তু বাধ সাধলেন ক্যাপ্টেনের বউ তিনি চিৎকার করে উঠলেন " ওটাকে কেউ মেরো না , কেউ মেরো না ওকে" সব থেকে আশ্চর্য যে ওই শুশুকটা ঠিক জাহাজের আগে চলতে থাকল চারিদিকে ঘন কুয়াশা, দূরের কোন কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না নিরুপায় হয়ে ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলেন শুশুকটাকেই অনুসরণ কর ক্যাপ্টেন আশা করেছিলেন যে শুশুক টা যে পথে যাচ্ছে সেই পথে হয়তো কোন ডুবোপাহাড় বা বিপদসঙ্কুল স্রোত থাকবে না জাহাজ এগিয়ে চলেছে, শুশুক তার পথ প্রর্দশক

অবশেষে ফ্রেঞ্চ-পাস নির্বিঘ্নে পার! সবাই আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে কিন্তু তাদের পথ প্রদর্শক বন্ধুটি কোথায় গেল ? সবাই অবাক হয়ে দেখল যে সে আবার ফিরে চলেছে সেই শুরু, তারপর থেকে পেলোরাস সাউন্ডের কাছে কোন জাহাজ এলেই জলের উপর লাফিয়ে উঠে জাহাজকে অভ্যর্থনা জানাত সে, তারপর সেই জাহাজের পথ প্রদর্শক হয়ে নির্বিঘ্নে পার করে দিত ভয়াবহ ফ্রঞ্চ-পাস সারাটা পথ জাহাজের সাথে থাকত সে তারপর আবার ফিরে আসত সে যেহেতু পেলোরাস সাউন্ডের মুখেই দেখা মিলত তার, সেইজন্য নাবিকরা তার নাম দিল পেলোরাস জ্যাক সারা দুনিয়ায় তার নাম মুখে মুখে ফিরতে লাগল এমনও দিন গেছে যে জাহাজ এসে পেলোরাস সাউন্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে , কোন কারণে পেলোরাস জ্যাকের আসতে দেরী হচ্ছে নাবিকরা চিৎকার করে ডাকতে লাগল, পেলোরাস জ্যাক! পেলোরাস জ্যাক! জলের উপর ডিগবাজী খেয়ে হাজির সে তারপর পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা জাহাজের ক্যাপ্টেন নিশ্চিন্তে তাকে অনুসরণ করার অনুমতি দিয়ে দেয় জাহাজকে পুরোপুরি পার করে দিয়ে ফিরে আসে সে 
           (photo taken by Capt. C. F. Post, of the N.Z. Govt. SS Tutanekai 1911)

1871 থেকে 1902 দীর্ঘ একত্রিশ (31yrs) বছর ফ্রেঞ্চ-পাস থেকে জাহাজকে রক্ষা করে চলছিল সে  তারপর এল 
 সেই দুঃস্বপ্নের দিন 
1903 সাল, পেলোরাস সাউন্ডের কাছে এসে দাঁড়াল এক জাহাজ - নাম পেঙ্গুইন যথারীতি পেলোরাস জ্যাক অভ্যর্থনা জানিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল জাহাজকে ওই জাহাজে ছিল এক মাতাল যাত্রী হঠা করে পেলোরাস জ্যাকের উপর গুলি চালিয়ে বসল সে যন্ত্রনায় লাফিয়ে উঠল জ্যাক, অতল সমুদ্রে ডুব দিল সে জাহাজের নাবিকরা ক্ষেপে গিয়ে মারতে আরম্ভ করল মাতাল যাত্রীটিকে খুন করে ফেলত তাকে কোনক্রমে তাদের হাত থেকে ক্যাপ্টেন রক্ষা করে যাত্রীটিকে টানা দু-সপ্তাহ দেখাগেল না পেলোরাস জ্যাককে জাহাজ পেলোরাস সাউন্ডের কাছে এলেই নাবিকরা জলের দিকে ঝুঁকে ডাকতে আরম্ভ করে তাকে, কিন্তু দেখা মিলল না তার সবাই ধরে নিল যে আর কোনদিন দেখা মিলবেনা তার কিন্তু না পেলেরাস জ্যাক মরেনি একটানা একত্রিশ বছর কাজ করার পর দু-সপ্তাহের ছুটি নিয়েছিল সে হয়তো গুলির ঘা শুকাবার জন্য ছুটির প্রয়োজন হয়েছিল তার ঠিক দু-সপ্তাহ পর দ্বিগুন উত্সাহে ডিগবাজী খেয়ে জাহাজের পথপ্রদর্শক হয়ে চলতে আরম্ভ করল সে এই ঘটনার পর কাউন্সিল থেকে অর্ডিন্যান্স জারী হয়ে গেল - যে পেলোরাস জ্যাকের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করবে, তার কঠিন শাস্তি হবে সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, সব জাহাজের পথ-প্রদর্শক হলেও পেঙ্গুইন জাহাজকে আর কোনদিন পথ চিনিয়ে নিয়ে যায়নি সে অবশেষে 1909 সালে ফ্রেঞ্চ-পাসে তলিয়ে যায় পেঙ্গুইন জাহাজ 
1871
থেকে 1909 পর্যন্ত দীর্ঘ আটত্রিশ (38yrs) বছরের মধ্যে ওই একটি মাত্র জাহাজ ফ্রেঞ্চ-পাসে তলিয়ে গিয়েছিল ক্রমে কেটে গেল আরও তিনটি বছর 
1912
সালের এপ্রিল মাস, দীর্ঘ চল্লিশ (40yrs) বছরের বিনা বেতনের চাকরী জীবন পূর্ণ করল পেলোরাস জ্যাক ঠিক চল্লিশ বছর আগে যেমন হঠা একদিন দেখা মিলেছিল তার, তেমনই হঠা করে অদৃশ্য হয়ে গেল সেনাবিকরা চিৎকার করে ডাকতে লাগল - পেলোরাস জ্যাক! পেলোরাস জ্যাক! কিন্তু না আর কোন দিন দেখে মেলেনি তার, আর কেউ কোনদিন লাফিয়ে উঠে ডিগবাজী খেয়ে অভ্যর্থনা জানায়নি কোন জাহাজকে 
পেলোরাস জ্যাক! পেলোরাস জ্যাক! গলার আওয়াজ মিলিয়ে যায় দিগন্ত বিস্তৃত অতল জলরাশিতে, সামনে শুধু ভয়ঙ্কর ফ্রেঞ্চ-পাস 
(
পুনশ্চ :- এই শুশুক বা ডলফিন যে প্রজাতির তার বিবরণ ছোট করে দিলাম .... Species :- Risso's dolphin, white coloured with grey lines or shadings, round white head, approx- 13ft (4m) long .......... 
যে গল্পটা বললাম এটা কোন কল্পকাহিনী নয় পেলোরাস জ্যাক অন্তর্জালে খুঁজলেই পেয়ে যাবে )

মন্তব্যসমূহ

  1. এইটা আমাদের ছোটোবেলায় শোনা সেই গল্প। ছোটোবেলাটা এক ধাক্কায় ফিরে এলো। পেলোরাস জ্যাক কে নিয়ে এক সুকুমার রায় ছাড়া কেউ লেখেননি বাংলায়। দারুন লাগল পড়ে।

    উত্তরমুছুন
  2. Osadharon lekha. Ek niswase pore fellam. Khub sohoj kore sundor kore lekha hoache. erokom r o lekhar asai roylam.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছোট্টবেলার ছড়া

আগমনী

দুঃখ বিলাস